কংক্রিটের চাপে সবুজের টিকে থাকা দায়

বর্তমানে কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ অন্তত ৫৫ শতাংশ। এ অবস্থায় আবার নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনায় সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানে এখন আর নিরিবিলি পরিবেশ নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে দোকানপাট ও কংক্রিটের অবকাঠামো। গতকাল বিকেলে নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানের কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ অন্তত ৫৫ শতাংশ। কংক্রিটের চাপে কোনোরকমে টিকে আছে সবুজ।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুকের নেতৃত্বে করা এক জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে সহায়তা করেন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. কাবিরুল সহিদ। গত মে মাসে এ জরিপ করা হয়।

এ অবস্থায় আবার নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বর্তমানে যে অংশে দোকান রয়েছে, একতলা অংশটি বর্ধিত করে দোতলা করা হবে।

নগরবাসী স্বস্তির জন্য খোঁজে সবুজের সমারোহসমৃদ্ধ উদ্যান। বিপ্লব উদ্যানে একসময় তা–ই ছিল। কিন্তু এখন তা হারিয়ে গেছে। নগরবাসীর জন্য এই উদ্যানের আগের চেহারা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চুয়েট

১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ২ নম্বর গেট গাছগাছালিতে ভরা ২ একরের এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়। আশপাশের মানুষের স্বস্তির একটি স্থান এ উদ্যান। অনেকে বিকেলের সময়টুকু কাটান এখানে। সেই স্বস্তি এখন কেড়ে নিচ্ছে কংক্রিটের যন্ত্রণা।

উদ্যানের সবুজ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশনের নগর–পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর। তাঁর মতে, বিপ্লব উদ্যানে কংক্রিটের অবকাঠামোর পরিমাণ ২৫–৩০ শতাংশের বেশি হবে। অবশ্য এই পরিমাণও গ্রহণযোগ্য নয়। আরও কম থাকা দরকার ছিল। একজন নগর–পরিকল্পনাবিদ হিসেবে মনে করেন, এভাবে স্থাপনা করতে দেওয়া উচিত হয়নি।

সবুজের প্রাণ যায় যায়

উদ্যানটি রক্ষণাবেক্ষণ করত সিটি করপোরেশন। ২০১৮ সালে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রি ফর্ম লিমিটেড ও স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ২০ বছরের জন্য ইজারা দিয়ে দেয় সংস্থাটি। এ জন্য বছরে রাজস্ব ধরা হয় মাত্র এক লাখ টাকা।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইজারা পেয়ে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করতে দেরি করেনি। এতে উদ্যানের মূল চরিত্রই পাল্টে গেছে। এখন উদ্যানের মূল অংশে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকান। একটি-দুটি নয়, এক সারিতেই আছে ১৯টি দোকান। উদ্যানের বড় অংশজুড়ে রয়েছে এসব দোকান ও দোকানে আসা ক্রেতাদের জন্য বসার আসন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উদ্যানের বড় অংশজুড়ে মানুষের যাওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। শুধু হাঁটার পথগুলো খোলা। সেগুলোও কংক্রিটের তৈরি। সবুজের চিহ্ন নেই। উদ্যানে থাকা চারটি বড় গাছও মরে গেছে। এ ছাড়া হাঁটাপথের পাশে একটু পরপর বসার আসন রাখা হয়েছে। দোকানগুলোর সামনের অংশ ঢালাই করা। এর মধ্যে এক সারিতে বসার আসন। উদ্যানের মাঝখানে রয়েছে পানির ফোয়ারা। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে ময়লা হয়ে আছে পানি।

একসময় বিপ্লব উদ্যানে হাঁটতে আসতেন নগরের আলফালাহ গলির বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী সৈয়দ সগীর (৭৮)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে উদ্যানের পরিবেশ ছিল নিরিবিলি। স্বস্তিতে হাঁটা যেত। বিশ্রাম নেওয়া যেত। কিন্তু এখন সেখানে প্রচুর দোকান হয়ে গেছে। সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগে থাকে। নিরিবিলি পরিবেশ আর নেই। উদ্যানের বর্তমান পরিবেশের কারণে সেখানে তাঁদের মতো বৃদ্ধ লোকদের যাওয়ার সুযোগ নেই।

নতুন অবকাঠামো করবে সিটি করপোরেশন

২০২০ সালে সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের আমলে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে উদ্যানের এক পাশে করা দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তবে সাবেক প্রশাসক ভেঙে দিলেও বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আবার দোতলা অংশটি করতে চান। অবশ্য এবার সেখানে কোনো দোকান দেওয়া হবে না। মূলত মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ইজারাগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান স্থপতি মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দোতলা ভবন অপসারণের পর মামলা করেছিলেন। সিটি করপোরেশনের মেয়র নিজেদের তহবিলে দোতলা নির্মাণ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাদুঘর করা হবে বলে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।

এদিকে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে করা চুক্তি সংশোধনেরও উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এতে বছরের রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

বিপ্লব উদ্যান নিয়ে সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিপ্লব উদ্যান নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখনো বাস্তবায়ন পর্যায়ে নেই। নীতিমালা না মেনে অবকাঠামো বা বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এখন যা করতে হবে

চুয়েটের গবেষক দলের জরিপে বলা হয়েছে, উদ্যানটিতে সবুজায়নের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আবার এই উদ্যানে সব শ্রেণির মানুষের যাতায়াত রয়েছে। কিন্তু সেখানে বাচ্চাদের জন্য আলাদা করে খেলার জায়গা থাকা দরকার ছিল, তা নেই। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী মানুষদের চলাচলের জন্য যে ধরনের সুবিধা (র‍্যাম্প) থাকা দরকার, তা অনুপস্থিত।

জরিপ পরিচালনা করা চুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক বোর্ড সদস্য মো. শাহ জালাল মিশুক প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বন্দরনগর চট্টগ্রামে প্রকৃতি-পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও কংক্রিটের ব্যবহারের মাধ্যমে পার্ক-উদ্যানের চরিত্র পরিবর্তন করে ফেলা হচ্ছে। এর ব্যতিক্রম হয়নি বিপ্লব উদ্যানেও। নগরবাসী স্বস্তির জন্য খোঁজে সবুজের সমারোহসমৃদ্ধ উদ্যান। বিপ্লব উদ্যানে একসময় তা–ই ছিল। কিন্তু এখন তা হারিয়ে গেছে। নগরবাসীর জন্য এই উদ্যানের আগের চেহারা ফিরিয়ে আনা জরুরি।