৬৩ কোটি টাকার প্রকল্পে অর্থছাড় কম, ব্যয়ও কম

দেশি-বিদেশি উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের অডিও-ভিজ্যুয়াল দলিল সংগ্রহ-সংরক্ষণসহ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সক্ষমতা বাড়ানো প্রকল্পের কার্যালয়ছবি: প্রথম আলো

দেশি-বিদেশি উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের অডিও-ভিজ্যুয়াল দলিল সংগ্রহ-সংরক্ষণসহ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সক্ষমতা বাড়ানো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হওয়া প্রায় ৬৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ১৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ছাড় হয়েছে। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পে অর্থছাড় কম, ব্যয়ও কম। বর্তমানে প্রকল্পের অগ্রগতি শতাংশের হিসাবে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে তাঁরা প্রকল্পটিকে ‘সফল’ মনে করছেন।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, অর্থছাড় অনুযায়ী কাজ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কাজও হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ফুটেজ কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ অবস্থায় প্রকল্পটির মেয়াদ সরকার বাড়াবে বলে তাঁরা আশাবাদী।

সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথ্য মন্ত্রণালয় (বর্তমানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়) পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ, সঠিক ইতিহাস রচনা–প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংগ্রহ-সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি নেয়। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভকে দেওয়া হয়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ফিল্ম আর্কাইভের কার্যালয়ের একটি ফ্লোরে প্রকল্প অফিস করা হয়। পরিচালকসহ প্রকল্পের মোট জনবল আটজন। ফিল্ম আর্কাইভের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ প্রকল্পের কাজে সহায়তা দিচ্ছেন।

ফিল্ম আর্কাইভের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যানুসারে, প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৬২ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ৩ জুলাই প্রকল্পটি ‘সি ক্যাটাগরির’ আওতায় চলে যায়। এর অর্থ, প্রকল্পে বরাদ্দ থাকলেও তা ব্যয় করা যাবে না। প্রায় পাঁচ মাস পর ‘সি ক্যাটাগরি’ থেকে প্রকল্পটিকে অবমুক্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘সি ক্যাটাগরির’ আওতায় যাওয়া, পর্যাপ্ত অর্থছাড় না পাওয়া, বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা—এসব কারণে প্রকল্পের আওতায় পর্যাপ্ত কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়নি।

ধীর অগ্রগতি

প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্যে বলা আছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ, সঠিক ইতিহাস রচনা-প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য দেশি-বিদেশি উৎস থেকে অডিও-ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে মুক্তিযুদ্ধের কর্নারসহ আধুনিক ফিল্ম মিউজিয়াম স্থাপন করা। ৪০০ বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা। প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ফিল্ম আর্কাইভের সক্ষমতা বাড়ানো। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো) ও ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম আর্কাইভসের (ফিআফ) সুপারিশ-নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ফিল্ম প্রিজারভেশন অ্যান্ড রেস্টোরেশন সিস্টেম’কে আধুনিক ও শক্তিশালী করা।

প্রকল্প সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত মাল্টিমিডিয়া আর্কাইভের বিশ্বখ্যাত সংস্থা ব্রিটিশ পাথে থেকে ১৫৬টি ফুটেজ ও গেটি ইমেজেস থেকে ৭৪টি ফুটেজ কেনা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংস্থা রেডঅরেঞ্জের সঙ্গে ফুটেজ কেনাসংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। ৫০ লাখ টাকা খরচ করে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে মিউজিয়াম বা জাদুঘরের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। আর্কাইভকে শক্তিশালী করতে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। ৬৪ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে পাওয়া তালিকা থেকে ৪০০ বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ২০০ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত কোনো ওয়ার্কশপ হয়নি। এ ছাড়া ফিল্ম আর্কাইভকে শক্তিশালী করার কাজও খুব একটা হয়নি।

অর্থছাড় কম, ব্যয়ও কম

সূত্র জানায়, প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছাড় দেওয়া হয় আড়াই কোটি টাকা। খরচ করা হয় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছাড় দেওয়া হয় পাঁচ কোটি টাকা। খরচ করা হয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। ২০২৩–২৪, অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের চলতি অর্থবছরের কর্ম ও ক্রয়সংক্রান্ত পরিকল্পনার নথিতথ্য বলছে, চলমান অর্থবছরে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, মোটাদাগে এ ব্যয়ের মধ্যে আছে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে তথ্যমন্ত্রীসহ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সফর বাবদ ৪৫ লাখ টাকা। সেমিনার/ওয়ার্কশপ বাবদ ১০ লাখ টাকা। মিউজিয়াম, আর্কাইভাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল দলিল সংগ্রহ বাবদ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ বাবদ ২৮ লাখ টাকা। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে ব্যয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে ফুটেজসহ বিভিন্ন কেনাকাটা প্রক্রিয়াধীন। ফলে শেষ নাগাদ এই অর্থবছরের মোট ব্যয় দাঁড়াতে পারে পাঁচ কোটি টাকা।

‘বড় কথা দুর্লভ ফুটেজ সংগ্রহ করেছি’

প্রকল্পটির পরিচালক মো. মোফাকখারুল ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কত টাকা ব্যয় হলো, তার চেয়ে বড় কথা হলো, আমরা বেশ কিছু দুর্লভ ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। এমন ১০০টি ফুটেজ সংগ্রহ করতে পারলেও প্রকল্পটিকে সফল বলা যায়। ব্রিটিশ পাথের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকার জায়গায় দরদাম করে ৫০ লাখ টাকায় ফুটেজ কিনতে পেরেছি। নিজে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক হিসেবে জানি, কোথায় কোন ধরনের তথ্য আছে। এখন শুধু ফুটেজগুলো সংগ্রহ করতে হবে।’

২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান মোফাকখারুল ইকবাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ভেতরে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোনো ফুটেজ নেই। বিভিন্ন দেশের আর্কাইভসহ যেসব জায়গায় ফুটেজ আছে, তা অ্যানালগ আমলের। ফুটেজ ডিজিটালে না থাকলে তা দেশে বসে যাচাই–বাছাই করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে অ্যানালগে থাকা ফুটেজ ডিজিটালে রূপান্তর করতে অনেক টাকা লাগে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৭ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি, ১৫ সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি, ফুটেজ সার্চিং কমিটি, মুক্তিযুদ্ধের বই সংগ্রহের কমিটি, বিশেষজ্ঞ কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটি আছে। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রকল্প বাস্তবায়নের বিশেষজ্ঞ কমিটির একজন উপদেষ্টা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ কমিটির সদস্যরা প্রকল্পের আওতায় যে কাজগুলো হচ্ছে, তা যাচাই–বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুপারিশ-পরামর্শ দিচ্ছেন। কাজগুলো করার ক্ষেত্রে কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, সেটি কমিটির সদস্যদের যাতে জানানো হয়, সে কথা তাঁরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বলে দিয়েছেন।

‘প্রকল্পের কাজকে পর্যাপ্ত বলার উপায় নেই’

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশের চেয়ারপারসন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ হাসান প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে, তাকে পর্যাপ্ত বলার কোনো উপায় নেই। তবে বেশ কিছু দুর্লভ ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।

এম এ হাসান আরও বলেন, সাক্ষাৎকারের জন্য ৪০০ বীর মুক্তিযোদ্ধার যে তালিকা প্রকল্পে এসেছে, তা কতটুকু সঠিক, বিষয়টির আরও যাচাই–বাছাই প্রয়োজন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে যাঁদের অবদান বেশি ছিল, তাঁরা এ তালিকা থেকে বাদ পড়লেন কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এ জন্য দরকার, যাতে কেউ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারেন।

ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক মো. জসীম উদ্দিন প্রকল্পটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারের আর্থিক অনুশাসনসহ বিভিন্ন বাস্তবতায় প্রকল্পের অর্থছাড় ও ব্যয় দুটোই কম হয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্পের কাজ হবে না।’