মানসিক সমস্যার জন্য ইন্টারনেটকে দায়ী করছেন ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী

প্রতীকী ছবি
ছবি: এএফপি

যেসব শিক্ষার্থী জীবনে কখনো না কখনো মানসিক সমস্যায় পড়েছেন, তাঁদের ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশই এর কারণ হিসেবে ইন্টারনেটের কোনো না কোনো ভূমিকার কথা বলেছেন। ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ অবসর কাটাতেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং অনেকেই আসক্তি অনুভব করছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া ব্যক্তিজীবনের প্রভাব, আচরণগত প্রভাবসহ নানা বিষয়ও তাতে তুলে ধরা হয়েছে।

আজ শনিবার আঁচল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রভাব: কতটুকু সতর্ক হওয়া জরুরি’ শীর্ষক সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস ইউনিটের সদস্য ফারজানা আক্তার।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সমীক্ষার কাজ হয়েছে। সমীক্ষায় ১ হাজার ৭৭৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন, যার মধ্যে নারী ৪৯ দশমিক ৫ এবং পুরুষ ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের আছেন শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।

জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা জীবনে কখনো না কখনো মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, তাঁদের মানসিক সমস্যার পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে।

মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে ইন্টারনেটকে পুরোপুরি দায়ী মনে করেন ২৬ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর মোটামুটি দায়ী ভাবেন ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ১৬ থেকে ১৯ বছর, ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর এবং ১০ দশমিক ৫ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩০ বছর। এসব শিক্ষার্থীর ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ অপরিমিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।

সমীক্ষা বলছে, পড়াশোনার কাজে ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কিন্তু পড়াশোনার ফাঁকে অনলাইনে প্রবেশ করলে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশের পড়াশোনার মনোযোগ হারিয়ে যায়।

স্বাভাবিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব

শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তাঁদের পড়াশোনার মনোযোগ নষ্ট করছে। ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে সময় ব্যয় তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ‘প্রচণ্ড নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলছে এবং ৫৭ দশমিক ২ শতাংশের স্বাভাবিক জীবনে ‘কিছুটা নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলছে।

৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আসক্তি অনুভব করেন। তাঁদের মধ্যে ‘খুব বেশি আসক্ত’ ২২ দশমিক ৪ শতাংশ, ‘মোটামুটি আসক্ত’ ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ‘অল্প আসক্ত’ ২০ দশমিক ৯ শতাংশ।

ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরির কথা জানিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। জরিপে শিক্ষার্থীদের ১৩ দশমিক ১ শতাংশ বলেছেন, ইন্টারনেটের ব্যবহার তাঁদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। এ ছাড়া ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ বলেছেন, অযাচিত কাজে সময় নষ্ট হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশের প্রতিদিন পরিমিত ঘুম হয় না। তাঁদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পরিমিত ঘুম না হওয়ার পেছনে তাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারকে পুরোপুরিভাবে দায়ী করেছেন।

পর্নোগ্রাফিতেও আসক্তির বিষয়ও উঠে এসেছে আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায়। শিক্ষার্থীদের ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি বা যৌন উত্তেজক বিষয়–সম্পর্কিত ওয়েবসাইট দেখেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের প্রভাব

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। অন্যের সফলতায় ১০ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর মনে হতাশার সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যম থেকে জানা অন্যের সফলতার খবর ১০ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ঈর্ষাকাতর করে তোলে এবং ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। অন্যদিকে, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এ ধরনের খবর থেকে উৎসাহিত হন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। জরিপের তথ্য অনুসারে, ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর ধৈর্যশক্তির হ্রাস ঘটে, ২৬ শতাংশ হঠাৎ রেগে যান, ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ চুপচাপ হয়ে যান। অন্যদিকে, ৩০ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, তাঁরা যখন অফলাইনে থাকেন, তখন একাকিত্বে ভোগেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিডের দুঃসংবাদের প্রভাবও তুলে ধরা হয়েছে এ সমীক্ষায়। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই দুঃসংবাদ বা কোনো ধরনের খারাপ খবর দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হন, ২১ দশমিক ৭ শতাংশ ট্রমায় আক্রান্ত হন, ৩৭ শতাংশের বেশি দুঃসংবাদটি মনে পড়লেই বিষণ্ন বোধ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, মানসিক সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানসিক অসুস্থতা তৈরি হয়। শিক্ষার্থীদের বড় অংশ প্রোডাক্টিভ কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। খেলার মাঠ কমে যাচ্ছে। বিকল্প হিসেবে তাঁদের কাছে ইন্টারনেট চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক চর্চাও আগের চেয়ে কমে গেছে।

সমস্যা সমাধানে আঁচল ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ করেছে—ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ডিজিটাল লিটারেসি প্রোগ্রাম’ চালু করা, কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা, খেলাধুলা ও ব্যায়ামাগারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের প্রোগ্রামার বিপ্লব চন্দ্র সরকার এবং টাঙ্গাইলের ডেপুটি সিভিল সার্জন মারুফ আহমেদ খান।