সাক্ষাৎকার: মৌটুসী কবীর

অনুকূল কর্মপরিবেশ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে  

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্র্যাক ও প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করেছে বিশেষ ক্যাম্পেইন: মনের ব্যথা, বলুক কথা।পেশাগত জীবনে মানুষ নানাভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে, এটি সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। কীভাবে এই বিষয়টি মোকাবিলা করা যায়—এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন ব্র্যাকের সিনিয়র ডিরেক্টর (পিপল, কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশনস) মৌটুসী কবীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারেক মাহমুদ নিজামী

প্রথম আলো:

আমরা কীভাবে প্রতিদিনের আলোচনায় মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কথা বলতে পারি?

মৌটুসী কবীর: বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় যে পরিমাণ মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ রয়েছেন তা অপ্রতুল। কাজেই এ ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে পরিবার, সমাজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বন্ধুমহলেও এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে একজন মানুষকে কিছু ধাপ পার হতে হয়। যদি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে উত্তম উপায় হতে পারে প্রতিদিনের আলোচনা। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকাদের আচরণ একটু ভিন্ন হয়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারেন না যে তিনি ঝুঁকিতে আছেন। তাই ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের কথা শিক্ষকেরা এবং কর্মীদের কথা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সহমর্মিতার সঙ্গে শুনবেন, তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেবেন না। সর্বক্ষেত্রে যদি এই চর্চাটা শুরু করা যায় তাহলে আলোচনার মাধ্যমে সহজেই মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব।

প্রথম আলো:

মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত কুসংস্কার প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কোন কৌশল বা উদ্যোগগুলো কাজে লাগতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

মৌটুসী কবীর: বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকাদের মধ্যে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যাই বেশি। এ জন্য স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত কুসংস্কার প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের নিজস্ব সার্কেল বা বন্ধুমহলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে বাবা-মায়েদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনটি পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে।

প্রথমত, কিশোর-কিশোরীদের কাছে সচেতনতামূলক বার্তাগুলো পৌঁছাতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য সহজবোধ্য ভাষাতেই বার্তাগুলো দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, যাঁদের কথায় তাঁরা প্রভাবিত হয়, তাঁদের মাধ্যমে বার্তাগুলো দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কার্যকর উপায় হতে পারে।

তৃতীয়ত, কর্মক্ষেত্রসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ভুল ধারণা দূর করতে হবে।

তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাঁরা এ বিষয়ে কথা বলবেন তাঁদেরও প্রয়োজনীয় জ্ঞান বা সক্ষমতা রয়েছে কিনা। যদি না থাকে, তাহলে প্রথমেই তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

শিশুদের বিকাশে ব্র্যাকের উদ্যোগ হিউম্যানেটেরিয়ান প্লে–ল্যাবে আনন্দমুখর মুহূর্ত
ছবি : ব্র্যাকের সৌজন্যে
প্রথম আলো:

কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? তারা কীভাবে সহায়তা পেতে পারেন?

মৌটুসী কবীর: কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা কোন স্তরে আছেন প্রথমেই সেটা জানতে হবে। যদি প্রাথমিকভাবে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ঝুঁকিটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় তাহলে সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিল প্রয়োজন হবে। কিন্তু ব্যক্তির সমস্যাটি যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকে সে ক্ষেত্রে দরকার হবে ক্লিনিক্যাল সহায়তার।
সহায়তার বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির কর্মস্থলের ওপর। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা আছে। তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই কর্মীর শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে একজন সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যিনি এ ধরনের ঝুঁকিতে থাকা কর্মীকে প্রাথমিকভাবে সহযোগিতা করবেন। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের সক্ষমতা না থাকে, তাহলে যে সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কাজ করে তাদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথম আলো:

পেশাগত মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ক্ষেত্রে কী কী ট্রেন্ড বা বেস্ট প্র্যাকটিস চালু রয়েছে, যা কর্মী ও নিয়োগদাতা সবার জানা প্রয়োজন?

মৌটুসী কবীর: প্রথমে মনে রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিটা আসে মানসিক চাপ থেকে। আর মানসিক চাপ আসে কর্মপরিবেশ বা নেতৃত্ব থেকে। তাই প্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা নিয়োগদাতাদের এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তাই ‘বেস্ট প্র্যাকটিস’ হিসেবে নিয়োগদাতা ও কর্মীর জন্য কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা। যখনই এ তিনটি বিষয়ের সংমিশ্রণ কোনো প্রতিষ্ঠানে থাকবে তখন আমরা ধরে নিতে পারব ওই প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ক্ষেত্রে বেস্ট প্র্যাকটিস চালু রয়েছে।  

প্রথম আলো:

মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশযোগ্যতা বাড়াতে প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ভূমিকা কী হতে পারে?

মৌটুসী কবীর: আগেই বলেছি, আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকাদের মধ্যে বেশির ভাগই কিশোর-কিশোরী। তাদের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই। তাই প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগানো গেলে ‘অ্যাকসেস গ্যাপটা’ কমে যাবে। তাই একজন সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর যে পরামর্শটা সরাসরি দেন, সেটি তিনি প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করেই দিতে পারেন। এতে একই সময়ে অনেকের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানোর সুযোগ থাকবে।

প্রথম আলো:

ব্র্যাক তাদের কর্মীদের উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?

মৌটুসী কবীর: এ বিষয়ে ব্র্যাকের তিন ধরনের পদক্ষেপ রয়েছে। এক, সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলরের মাধ্যমে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। দুই, বিভিন্ন সেশনের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, যা ‘ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টে’র সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে নিশ্চিত হচ্ছে। তিন, নির্দিষ্ট হেল্পলাইন সার্ভিস, যেখানে ফোন করলে কর্মীরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবাটা হাতের নাগালেই পেয়ে যান।

এ ছাড়া কর্মীদের জন্য অনুকূল কর্মপরিবেশ তৈরি এবং নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা নিশ্চিত করে যাচ্ছে ব্র্যাক।

প্রথম আলো:

কমিউনিটি স্তরের মানুষের জন্য সুষ্ঠু মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্র্যাকের প্যারা-কাউন্সিলর মডেলের মাধ্যমে কী কী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে?

মৌটুসী কবীর: এ ক্ষেত্রে ব্র্যাকের দুটি উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি ‘হিউমেনেটেরিয়ান প্লে-ল্যাব মডেল’। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা-শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমরা একটা বিষয় উপলব্ধি করেছি। সেটা হলো, যেহেতু তারা এক ধরনের ট্রমার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে, তাই তাদের পড়াশোনার বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার আগে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সেবা দিতে হবে। সে জন্য পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করেছি। ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশে আমাদের এই ‘হিউমেনেটেরিয়ান প্লে-ল্যাব মডেল’ নিয়ে কাজ শুরুর চিন্তা-ভাবনা চলছে। কারণ এটি বিশ্বের যেকোনো রিফিউজি ক্যাম্পের জন্যই প্রযোজ্য।

আর দ্বিতীয়টি হলো, কমিউনিটিভিত্তিক ‘প্যারা-কাউন্সিলর মডেল’। এর মাধ্যমে আমরা চেয়েছি মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রাথমিক পর্যায়েই একজন ব্যক্তি যেন সেবাটা গ্রহণ করতে পারেন। কারণ এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ যদি প্রাথমিক পর্যায়ে কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মানসিক চাপ অনেকখানিই কমে যায়। এই মডেলের আওতায় বর্তমানে ব্র্যাকের উদ্যোগে সারা দেশে আট শতাধিক প্যারা কাউন্সিলর সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কমিউনিটি পর্যায়ে মডেলটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা চলছে। ইতিমধ্যে এই মডেলটি নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে থাকা নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি) প্রোগ্রামের সঙ্গে ব্র্যাকের একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়েছে।  

ধন্যবাদ আপনাকে।

মৌটুসী কবীর: আপনাকেও ধন্যবাদ।