কথিত প্রকল্পের নামে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রতাপপুর পাবলিক নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি ভরাটের জন্য চার লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ টাকার পুরোটাই উত্তোলন করা হলেও কাজ হয়নি। গত ২৫ আগস্ট তোলা ছবিপ্রথম আলো

কিছু প্রকল্পের অস্তিত্ব নেই, কিছু প্রকল্পে কোনো কাজই হয়নি। এমন নামসর্বস্ব প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে তছরুফ করা হয়েছে কোটি টাকা। সুনামগঞ্জের শাল্লায় অতিদরিদ্রদের জন্য সরকারের কাবিখা, কাবিটা ও টিআরের ২৫৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

গত অর্থবছরে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ৬ কোটি ৩৭ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৫ টাকা, ১২৯ মেট্রিক টন চাল ও ১০৬ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ আসে। কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে মোট বরাদ্দের ৪ কোটি ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৩২৫ টাকা এবং সব চাল ও গম তুলে নেওয়া হয়েছে।

গত ২৫, ২৬ ও ২৭ আগস্ট প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ৪০টি প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে যান। এর মধ্যে ১৮টি স্থানে প্রকল্পের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজে লেখা থাকলেও বাস্তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র দেখা যায়নি। পাঁচটিতে সঠিকভাবে কাজ হওয়ার চিত্র দেখা গেলেও অন্য ১৭টিতে নামমাত্র কাজ হতে দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অস্তিত্বহীন ১৮টি প্রকল্পের বিপরীতে তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৭ লাখ ৫ হাজার ৮৮২ টাকা এবং সাড়ে ১৯ মেট্রিক টন চাল। স্থানীয়দের অভিযোগ, কথিত এসব প্রকল্পের পাশাপাশি কাজ না করেই বরাদ্দের অন্তত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।

উপজেলা কৃষক লীগের আহ্বায়ক রণজিৎ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে শাল্লায় কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে কোনো কাজ না করেই টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে। কোথাও কাজ হয়েছে নামমাত্র। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) যোগসাজশে বরাদ্দ লোপাট হয়েছে। অথচ এসব প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বিশাল জনগোষ্ঠী সুফল পেত।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় বিষ্ণুপুর গ্রামের তরনী দাসের বাড়ি থেকে নদীর পাড় বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রাস্তা পুননির্মাণের জন্য তিন মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়েছিল। তবে এখানে কোনো মাটি ফেলা হয়নি বলে বাসিন্দারা জানিয়েছেন। গত ২৫ আগস্ট তোলা ছবি
প্রথম আলো

পিআইও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তার অনুকূলে ২০২১-২২ অর্থবছরে তিন ধাপে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্যশস্য) কর্মসূচিতে ৪৪টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৬২ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ মেট্রিক টন গম। এ ছাড়া সংসদ সদস্যের অনুকূলে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের (টিআর) ৫৮টি প্রকল্পে চার ধাপে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫৬ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই ও শাল্লা) আসনের সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম, হাসপাতালেও ছিলাম দীর্ঘদিন। কেউ আমাকে ওইভাবে এসব বিষয়ে বলেনি। তবে প্রকল্পগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
পিআইওর কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিকদের দিয়ে কর্মসংস্থান কর্মসূচির কাজ করানোর বিধান আছে। দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ছিল ৪০০ টাকা। এ টাকা শ্রমিকদের মুঠোফোন নম্বরে জমা হয়েছে।

কিন্তু একাধিক শ্রমিকের অভিযোগ, নামমাত্র কাজ করে, কোথাও কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু উপকারভোগীদের মুঠোফোন নম্বরে বিল জমা হওয়ার বিধান আছে, তাই প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের অনেকে পরিচিতজন ও আত্মীয়স্বজনদের মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করে বিল তোলেন। এ ছাড়া অনেক প্রকল্পের সভাপতি কিছু সিম কিনে সেসব শ্রমিকের নম্বর দেখিয়ে বিল আত্মসাৎ করেন। শ্রমিকদের কাজ করার কথা থাকলেও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এক্সকাভেটর দিয়ে কাজ করিয়ে বিল তুলেছেন।


আমি অসুস্থ ছিলাম, হাসপাতালেও ছিলাম দীর্ঘদিন। কেউ আমাকে ওইভাবে এসব বিষয়ে বলেনি। তবে প্রকল্পগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
জয়া সেনগুপ্তা, স্থানীয় সংসদ সদস্য

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে পিআইও সরদার মো. ফজলুল করিম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, প্রকল্পের কাজ ঠিকভাবেই হয়েছে। শ্রমিকেরাই কাজ করেছেন এবং তাঁদের নির্দিষ্ট নম্বরেই টাকা জমা হয়েছে। অনিয়মের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

টিআর (সাধারণ) কর্মসূচির আওতায় বাহাড়া ইউনিয়নে লাইটিং এরিস্টার (বজ্রনিরোধক দণ্ড) স্থাপন এবং ডিজিটাল লাইটিং কাউন্টিং মেশিন স্থাপন করতে দুটি পৃথক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কাগজপত্রে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে দুটি প্রকল্পের ছয় লাখ টাকা তুলে নেওয়া হলেও বাস্তবে কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই ইউনিয়নে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে জিআই অ্যালিভেশন পোল, আর্থিং পিট, আর্থিং বক্স, ডাউন কন্ডাক্টর স্থাপন হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই।

টিআর কর্মসূচির আওতায় ঘুঙ্গিয়ারগাঁও সদর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা লোকজনদের বসার স্থান তৈরি বাবদ ১ লাখ টাকা, শাল্লা ইউপির আসবাব কেনা বাবদ ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৫ টাকা, দাড়াইন বাজার কালীমন্দির উন্নয়ন বাবদ ১ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হলেও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের সভাপতিরা দাবি করেছেন, শিগগির তাঁরা কাজ শুরু করবেন।

টিআর (সাধারণ) কর্মসূচিতে বাহাড়া ইউপির শৌচাগার নির্মাণ ও পরিষদের উন্নয়নের জন্য ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ টাকা উত্তোলন হলেও কাজ হয়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আটগাঁও ইউনিয়নে বিমান চৌধুরীর বাড়ি থেকে মামুদনগর বাজারের রাস্তা, মামুদনগর লক্ষ্মীমন্দিরের সামনের অংশ, মার্কুলি গ্রামে কামাল মিয়ার বাড়ি থেকে কুশিয়ারা নদীর পাড় পর্যন্ত রাস্তা, প্রতাপপুর পাবলিক নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ, ঘুঙ্গিয়ারগাঁও খাদ্যগুদামের রাস্তা থেকে সরকার বাড়ি দুর্গামন্দিরের প্রাঙ্গণ রাস্তা, ফয়জুল্লাপুর সমুজ আলীর বাড়ি থেকে কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তা এবং বিষ্ণুপুর গ্রামে তরনী দাসের বাড়ি থেকে নদীর পাড় বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রাস্তায় কোনো মাটি ফেলা হয়নি। অথচ এসব স্থানে মাটি ভরাটের তথ্য দেখিয়ে সাতটি প্রকল্পের বিপরীতে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং সাড়ে ১৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নেওয়া হয়েছে।

কাবিখা কর্মসূচিতে শাল্লা কিন্ডারগার্টেনের মাঠে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় আড়াই মেট্রিক টন চাল। ২৭ আগস্ট সরেজমিনে দেখা গেছে, মাঠে কোনো মাটি ফেলা হয়নি। তবে এ প্রতিবেদক ঘুরে আসার পরদিন থেকে মাঠে মাটি ভরাটের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ দীপু রঞ্জন দাস ওই প্রকল্পের সভাপতি। তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। দীপু বলেন, বন্যার কারণে মাটি ফেলা যায়নি। সম্প্রতি ফেলে শেষ করা হয়েছে।

১৮টি অস্তিত্বহীন প্রকল্পের নাম উল্লেখ করে পিআইও সরদার মো. ফজলুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, এসব অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে কিছু প্রকল্পের কাজ বন্যাসহ কিছু কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পের টাকা উত্তোলন করলেও খরচ হয়নি। দ্রুতই এসব বাস্তবায়ন করা হবে।

২০২১-২২ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় দুটি ধাপে ৩০টি করে সর্বমোট ৬০টি প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে দ্বিতীয় ধাপের কাজ চলাকালে গেল জুনের মাঝামাঝি বন্যা চলে আসায় অনেকে কাজ না করেই বিল তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে প্রকল্পগুলোর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে বন্যার কারণে কিছু কাজ শেষ হয়নি। বন্যা শেষ হওয়ায় কিছু কাজ চলমান আছে এবং কিছু কাজ শুরু করা হবে।