প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৪৮ কোটি টাকা

  • ২০২১ সালে ৪১৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প অনুমোদন।

  • গত মাসে দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাবে ব্যয় ৭১০০ কোটি টাকা।

  • পুনর্বাসন ব্যয় ১০৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব।

ঝিনাইদহ–যশোর মহাসড়কের পাশে নির্মাণ করা চারতলা ভবন। সম্প্রতি যশোর সদর উপজেলার মানিকদিহি এলাকায়ছবি: আজাদ রহমান

ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক ছয় লেন করতে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১৪৮ কোটি টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে কিলোমিটারে বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে ৬১ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরামর্শক ব্যয় বাড়তি দেখিয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবটি দিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।

পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো ওই প্রস্তাবে দেখা গেছে, প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। পরে গত মাসে প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে এ-সংক্রান্ত প্রথম সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সওজ। এতে জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ৩ গুণ বাড়িয়ে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণপ্রক্রিয়া ও পরামর্শকের পেছনে ব্যয় নিয়ে নানা সময় প্রশ্ন উঠেছে। সড়ক নির্মাণে বেশি খরচের বিষয়টিও আলোচিত। এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা জমি অধিগ্রহণপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা ও সড়ক নির্মাণে ব্যয় বেশি হওয়ার মূল কারণ অনুসন্ধান করে এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

২০২১ সালে ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয় ৮১৮ কোটি টাকা। গত মাসে সেই জমি অধিগ্রহণে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।

এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শক ব্যয়, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও পুনর্বাসন ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রশ্ন উঠেছে। কমিশনের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে কমিশন সওজের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে। সার্বিক বিষয় নিয়ে আজ রোববার পরিকল্পনা কমিশনে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তখন প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ সংশোধনী প্রস্তাবে ব্যয় ২ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণের বাইরে পুনর্বাসন ব্যয় ১০৪ কোটি টাকা ও পরামর্শক ব্যয় ৩৭ কোটি টাকা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতি শতকে বাড়তি দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা

৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়ক বর্তমানে দুই লেনের। মহাসড়কের ছয় লেন নির্মাণে ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণ করার কথা। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয় ৮১৮ কোটি টাকা। তখন প্রতি শতক জমির দাম ধরা হয় ২ লাখ ১৯ হাজার টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ প্রস্তাবে প্রতি শতকের দাম ধরা হয়েছে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ প্রতি শতকে বাড়তি দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৭ সালে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন পাস হয়। এর পর থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণে দামের ক্ষেত্রে ‘বাণিজ্য’ শুরু করেন অসাধু ব্যক্তিরা। এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি জমির মূল্যের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পান। তা ছাড়া অধিগ্রহণের নোটিশ দেওয়ার আগে যদি কেউ জমিতে স্থাপনা করেন, তাহলে স্থাপনার ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় দুই গুণ। তবে নোটিশ দেওয়ার পর আর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। যদিও নোটিশ জারির আগেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যোগসাজশ করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলেন।

দেশে সড়ক নির্মাণে খরচ বেশি। এখানে উন্নয়নের নামে একশ্রেণির মানুষকে অর্থ উপার্জনের অবৈধ সুযোগ করে দেওয়া হয়।...কিসের ভিত্তিতে সওজ এসব খরচ নির্ধারণ করেছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

৪ জুলাই সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর সদরের বারীনগর বাজার এলাকার মানিকদিহিতে ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের পাশে চারতলা ভবন। ফাঁকা মাঠের মধ্যে ইটের ভাটার সঙ্গেই নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটি। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দোতলা ভবনটি বছরখানেক আগে হয়ে গেছে চারতলা। পাশেই রয়েছে আরেকটি দোতলা ভবন, সেটিও বছর দেড়েক আগে নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিনাইদহ বাস টার্মিনাল থেকে যশোরের পালবাড়ী পর্যন্ত ঘুরে মহাসড়কের পাশে অন্তত ৩৫টি পাকা, সেমিপাকা ও টিনশেড ঘর দেখা গেছে।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র বলছে, জমি অধিগ্রহণে সদর উপজেলায় নোটিশ দেওয়া হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। এর আগেই সদর উপজেলায় সড়কের দুই পাশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট দোকানপাট, বাজার হয়েছে। কারখানা হয়েছে। চালকল হয়েছে।

কীভাবে জমির দাম ধরা হলো

জেলা প্রশাসন জমির দাম নির্ধারণ করে। যদিও সওজ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জমির দাম নির্ধারণ না করেই সংশোধনী প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একটি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয় ২০২২ সালে। অথচ এ আদেশ জারির এক বছর দুই মাস পর ওই আদেশের বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে জানানো হয়। এরই মধ্যে স্থানীয় লোকজন দুই পাশে স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এস এম রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এখনো জমির দাম ঠিক করেনি। দাম কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে, তা তিনি জানেন না। তবে দাম নির্ধারণের কাজ চলছে বলে তিনি জানান।

এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের দাম কীভাবে ঠিক হলো, তা জানতে সওজসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালে ধারণার ওপর নির্ভর করে জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করার সময় জমির ওই প্রাথমিক মূল্যটি দিয়ে দেয়। সেই প্রস্তাবই একনেকে পাস হয়। এবারও (প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী) জমির মূল্য ধরা হয়েছে ‘অনুমানের’ ওপর। এখন জমির বর্তমান বাজারদর, হালনাগাদ মৌজা দরের কারণে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বেড়ে গেছে। এটাও সম্ভাব্য ব্যয় প্রস্তাব।

প্রকল্প পরিচালক ও সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাবেদ হাসানের সঙ্গে গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

ঝিনাইদহ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন ১৫ জুন প্রথম আলোকে বলেন, সওজ জমির একটা দাম ধরে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে চূড়ান্ত দাম পাওয়ার পর তা সমন্বয় করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘জমির মূল্য নির্ধারণ যেভাবে হয়েছে, সেটিকে আপনি ত্রুটি বলতে পারেন। চূড়ান্ত নোটিশ (৪ ধারা) দেওয়ার আগে অনেকে জমিতে স্থাপনা করে ফেলেছেন।’

পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানোর আগে তা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জমির মূল্য নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। সড়ক মন্ত্রণালয় শুধু দেখে কাগজপত্র ও প্রক্রিয়া ঠিক আছে কি না। এ মন্ত্রণালয়ে দেড় শতাধিক প্রকল্প আছে। এভাবে খুঁটিনাটি বিষয় দেখার সময় থাকে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বরে অনুমোদন পাওয়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১৪০ কোটি টাকা। এর আগে অনুমোদন পাওয়া ঢাকা-সিলেট বিদ্যমান দুই লেনের সড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ৮২ কোটি টাকা।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ তুলনামূলক বেশি। এখানে উন্নয়নের নামে একশ্রেণির মানুষকে অর্থ উপার্জনের অবৈধ সুযোগ করে দেওয়া হয়। জমি অধিগ্রহণের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা হয়। তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণের মতো প্রকল্পেও পরামর্শক নিয়োগ করে এ খরচ আরও বাড়ানো হয়। কিসের ভিত্তিতে সওজ এসব খরচ নির্ধারণ করেছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আজাদ রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক, ঝিনাইদহ]