জলাভূমির উদ্ভিদ শোলা

জলাশয়ে শোলাগাছ, রাজশাহী থেকে তোলাছবি: লেখক

বরিশাল স্বাদুপানির জেলা। সেখানে সবুজ ধানখেতে নদী থেকে জোয়ার আসে। জলাশয়গুলো বর্ষার সময় জলজ আগাছায় ভরে যায়। মলিন শামুকের খোলসে শেওলা জন্মে। সেই শেওলাও বাড়ে, কার্পেটের মতো বিছিয়ে যায় খোলসের ওপর। যে কারণে শামুক-শিকারি পাখি যেমন বাংলা কুবো, শামুকখোল তাদের দেখতে পায় না। এসব জলাশয়ের জলজ আগাছায় সবুজ রঙের ঘাসফড়িং থাকত। আমরা বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরার জন্য ঘাসফড়িং ধরতে জলে নামতাম।

ছেলেবেলায় একদিন বরিশালের হবিনগর গ্রামের একটি জলজ আগাছাময় পরিত্যক্ত ধানখেতে ঘাসফড়িং ধরতে গিয়ে একটি উদ্ভিদ দেখি। কাণ্ড খুব হালকা। পানিতে ভেসে থাকে। এত হালকা যে হাতে নিলে টের পাওয়া যায় না। কেউ একজন আমাকে বললেন এটি শোলাগাছ, খুব বিরল। সেদিন প্রথম শোলা উদ্ভিদ চেনা।

বরিশালের গ্রামে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে দু-একটা জলাশয়ে শোলাগাছ দু-চারটি দেখতাম। এরপর কয়েক দশকে আর কোনো শোলা উদ্ভিদ দেখিনি। সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারের কোনো হাওরে না। দেশের দক্ষিণের জেলা ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা গিয়েও কোনো জলাশয়ে শোলা চোখে পড়েনি। তবে এসব এলাকায় শোলা থাকতে পারে, তবে আমার দেখা জলাশয়গুলোতে আমি দেখিনি।

বছর কয়েক আগে তপ্ত গ্রীষ্মে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর এলাকায় বুনো ফুল খুঁজতে গিয়ে একটি পরিত্যক্ত জলে টইটম্বুর ফসলের মাঠে হলুদ রঙের ফুল দেখি। উদ্ভিদগুলোর পাতা অনেকটা লজ্জাবতীর পাতার মতো। ফুল অনেকটা শিম ফুলের গড়ন। কাণ্ডসমেত উদ্ভিদটি জলের ওপর ভাসছে। হ্যাঁ, তখনই ছেলেবেলার দেখা শোলার রূপটি স্মৃতির পাতা থেকে আমার মনে ভাসল। এ তো সেই শোলা উদ্ভিদ। পরে বইপত্র ঘেঁটে জানতে পারলাম, শোলা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু জেলার জলাশয়ে কিছুটা সহজলভ্য।

শোলা একটি কাণ্ডসর্বস্ব গাছ। কাণ্ডের বাইরের আবরণটা মেটে রঙের, কিন্তু ভেতরটা সাদা। শোলাগাছ সাধারণত ৫-৬ ফুট লম্বা হয় এবং কাণ্ডের ব্যাস হয় ২–৩ ইঞ্চি। বাংলাদেশে দুই প্রকার শোলা জন্মে: কাঠশোলা ও ভাটশোলা। কাঠশোলা অপেক্ষাকৃত শক্ত, কিন্তু ভাটশোলা হালকা ও নরম। শোলা বর্ষাকালীন জলজ সপুষ্পক উদ্ভিদ। শিম ফুল আকৃতির সুন্দর হলুদ রঙের ফুল ফোটে। গাছগুলো মোটামুটি ১ ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি মোটা হয়। এই উদ্ভিদের আদিনিবাস বাংলাদেশ, ভুটান, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। গ্রামবাংলার খাল, বিল, পুকুর, ডোবা, পতিত জলাশয়ে এদের বেশি দেখা যায়।

শোলাশিল্প বাংলার অন্যতম লোকজ শিল্প। এ শিল্পের কাঁচামাল হলো শোলা। শোলাগাছ জলাশয়ে, বিশেষত বিল ও ধানখেতে জন্মে। শোলাগাছ বিলে যত জল পায়, তত বাড়ে ও মোটা হয়। শোলা দুই জাতের। মালাকারি কাজে ফুল শোলার দরকার হয়। শোলা দিয়ে তৈরি হয় বর-কনের বিয়ের মুকুট, মুখোশ, পূজার উপকরণ আর নানা ধরনের খেলনা। নওগাঁ ও রাজশাহীর রক্তদহ বিল, আত্রাই বিল, দীঘলি বিল ও খলিমারা বিলে অনেক শোলা দেখা যায়। 

মালাকার সম্প্রদায়ের শোলা কাটার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় দুর্গাপূজার দশমীর দিন। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘শোলা সাইত’। মালাকাররা বংশানুক্রমে শোলা দিয়ে বৈচিত্র্যময় টোপর, দেব-দেবীর অলংকার, চালচিত্র, পূজামণ্ডপের অঙ্গসজ্জার দ্রব্যাদি, মালা, গয়না, খেলনা ও গৃহসজ্জার নানা দ্রব্য তৈরি করে।

মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা), মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, যশোর, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল অঞ্চল শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। শোলাশিল্প নিয়ে একটি বই আছে মালাকার সম্প্রদায় ও শোলাশিল্প নামে। বইটির লেখক সাকার মুস্তফা। মালাকারদের মধ্যে একটা কিংবদন্তির প্রচলন আছে-হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করার সময় মহাদেব শিব শ্বেত মুকুট পরার ইচ্ছা পোষণ করেন। এই ইচ্ছা পোষণ থেকেই জলে জন্ম নিল শোলাগাছ।