শব্দদূষণ ঘটালে এখন পুলিশও জরিমানা করবে

শব্দদূষণ রোধে যানবাহনের চালক ও সহকারীদের সচেতন করতে ঢাকার সড়কে প্ল্যাকার্ড হাতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রিন ভয়েসের সদস্যরাফাইল ছবি: প্রথম আলো

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে জরিমানা করার ক্ষমতা পেয়েছে পুলিশ।  শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করলে সার্জেন্ট বা তার ওপরের পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবেন। জরিমানা পরিশোধ করতে না পারলে তৎক্ষণাৎ মোটরযানটি আটক করতে পারবে পুলিশ।

এমন বিধান রেখে ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। গত ২৩ নভেম্বর জারি করা এই বিধিমালার বিধি-২০–এর উপবিধি-১–এ পুলিশকে এ ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মোটরযান বা নৌযানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী হর্ন স্থাপন ও ব্যবহার করতে পারবেন না। এটির লঙ্ঘন করা হলে ঘটনাস্থলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে পুলিশ।

বিধিমালার তফসিল-৩–এ দুই ও তিন চাকার হালকা যানের ক্ষেত্রে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ ডেসিবেল (শব্দ মাপার একক)। অন্যান্য হালকা যান, যেমন মোটরগাড়ি, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যানের ক্ষেত্রেও এ মানমাত্রা একই থাকবে। অন্যদিকে মিনিবাস, মাঝারি ট্রাক, মাঝারি কাভার্ড ভ্যানের ক্ষেত্রে এটি নির্ধারণ হয়েছে সর্বোচ্চ ৯০ ডেসিবেল। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরি ও নৌযানের মতো ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে এই সীমা ১০০ ডেসিবেল।

বিধিমালার তফসিল-১–এ কোন এলাকায় কত ডেসিবেল শব্দের মানমাত্রা হবে, তা–ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের অনুমোদিত মানমাত্রা হবে ৫০ ডেসিবেল, রাতের বেলায় ৪০ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকায় দিনের বেলায় ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল। মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবেল, রাতে ৫০ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবেল, রাতে ৬০ ডেসিবেল। শিল্প এলাকায় শব্দের মানমাত্রা দিনের বেলায় ৭৫ ডেসিবেল ও রাতের বেলায় ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হবে।

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালার আওতায় সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো নির্দিষ্ট এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করে সেখানে শব্দের মাত্রা ঠিক করে দিতে পারে।

দুই ও তিন চাকার হালকা যান, মোটরগাড়ি, মাইক্রোবাসের ক্ষেত্রে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা ৮৫ ডেসিবেল; মিনিবাস, মাঝারি ট্রাকের ক্ষেত্রে ৯০ ডেসিবেল; বাস, ট্রাক, লরির ক্ষেত্রে ১০০ ডেসিবেল।

সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত দিন হিসেবে গণ্য হবে। রাতের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে রাত নয়টা থেকে সকাল ছয়টা।

এত দিন পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন কার্যকর করতেন। এখন পুলিশও সেই ক্ষমতা পেল।

আরও পড়ুন

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্পের পরিচালক ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বিধিমালায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো পুলিশকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

ফরিদ আহমেদ বলেন, গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারসহ ১০০ জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করে এ বিধিমালা সম্পর্কে তাঁদের জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের হাতে সাউন্ড লেভেল ডিটেক্টর (শব্দের মাত্রা শনাক্তকারী যন্ত্র) দেওয়া হয়েছে।

‘আশা করছি, নাগরিকেরা শব্দদূষণের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবেন,’ বলেন ফরিদ আহমেদ।

নীরব এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে মাইক, লাউডস্পিকার নিষিদ্ধ

জাতীয় নির্বাচনের আগে জারি করা এই বিধিমালায় উচ্চ শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মাইক, লাউডস্পিকার ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। নীরব এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায়ও তফসিল-১–এর মানমাত্রা অনুসরণ করতে হবে। এই নিয়ম সব নির্বাচনেই খাটবে।

আইনের প্রয়োগ করার কথা ছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু তাদের সে অর্থে কোনো জনবল নেই। ফলে এ সমস্যা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। বিধিমালায় পুলিশকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এ ইতিবাচক ফল আমরা আশা করতে পারি।
আলমগীর কবির, সাধারণ সম্পাদক, বাপা

বিধিমালার বিধি-৫–এ রাতের বেলায় জনপরিসরে লাউডস্পিকার, মাইক, সুরযন্ত্র (মিউজিক সিস্টেম), অ্যামপ্লিফায়ার (শব্দের মাত্রা বাড়ায় এমন যন্ত্র) ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য লিখিত আবেদন করে পাঁচ ঘণ্টার জন্য রাতের বেলায় নীরব এলাকা ছাড়া এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুমোদন নিতে পারবেন যে কেউ। তবে রাত ১১টার পর এসব উচ্চ শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। আর ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ করা যাবে না।

আরও পড়ুন

গ্রাম, পৌর ও উপজেলা এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে এ অনুমতি নিতে হবে। জেলা সদরে জেলা প্রশাসক ও সিটি করপোরেশন এলাকায় পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

বিধিমালা অনুসারে রাতের বেলায় পটকা, আতশবাজি ও অনুরূপ শব্দ তৈরি করে—এমন কোনো কিছুর বিস্ফোরণ ঘটানো যাবে না। বিধিতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, বনভোজনের বা সামাজিক অনুষ্ঠানের যানবাহনেও শব্দদূষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রথম আলো গ্রাফিকস

আবাসিক এলাকায় নির্মাণকাজের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আবাসিক এলাকা ও আবাসিক এলাকা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কোনো ধরনের ইট ও পাথর ভাঙার যন্ত্র, মিক্সচার মেশিন, পাইলিং মেশিনসহ মতো বেশি শব্দ করা যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিধিমালায়।

শব্দদূষণে আক্রান্ত ব্যক্তি টেলিফোনে, লিখিত বা মৌখিক উপায়ে অথবা ই-মেইলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগ পাওয়ার পর সত্যতা যাচাই করে উচ্চ শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি আটক করতে পারবেন।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে তৎপর পুলিশ
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি প্রতীকী ছবি

শব্দদূষণের শাস্তি কী

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে বিধিমালা জারি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। তাতে জনপরিসরে অনুমতি ছাড়া মাইক, লাউডস্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, মিউজিক সিস্টেম, অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করলে কিংবা পটকা, আতশবাজি ফুটালে ১ মাস কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যদিকে সড়কে মোটরযান শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করলে ৩ মাস কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। অতিরিক্ত শাস্তি হিসেবে চালকের ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।

বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময় প্রতি চালককে ১০ পয়েন্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়, ট্রাফিক আইন ভাঙলে পয়েন্ট কাটা পড়তে থাকে। ১০ পয়েন্ট কাটা পড়লে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়।

শব্দের মানমাত্রা ছাড়িয়ে যায় এমন হর্ন, হাইড্রোলিক হর্ন, মাল্টিটিউন হর্ন ও সহায়ক যন্ত্র আমদানি, মজুত, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ ও প্রদর্শন করলে ১ মাসের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

পুলিশ এখন শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাওয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর আর এ বছরের অক্টোবর আমরা শব্দদূষণ নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ করেছিলাম। তখন আমরা দেখেছি, আইন থাকলেও প্রয়োগ ছিল না। আইনের প্রয়োগ করার কথা ছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু তাদের সে অর্থে কোনো জনবল নেই। ফলে এ সমস্যা দিনের পরদিন বেড়ে চলেছে।’

এই বিধিমালায় পুলিশকে যে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার যথাযথ প্রয়োগ হলে ইতিবাচক ফল আশা করা যায়, বলেন তিনি।

দূষণ নিয়ন্ত্রণে বাসস্টেশন, টার্মিনালে চালকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন আলমগীর কবির। তিনি আরও বলেন, হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি কারা করছে, বাজারজাত কোথায় হচ্ছে, তার ওপরও শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ দরকার।