ময়নাতদন্তে হত্যাকাণ্ড, পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে আত্মহত্যা

কোহিনূর বেগমছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে গত বছরের ১০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কে বি এম মামুন রশিদ চৌধুরীর স্ত্রী কোহিনূর বেগমের (৬৫) নিথর দেহ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ঘটনাটি ‘হত্যাকাণ্ড’। কোহিনূর বেগমের স্বজনদের অভিযোগও ছিল তা–ই। তবে মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সম্প্রতি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে, কোহিনূর বেগম অসুস্থতাজনিত হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছেন।

কোহিনূর বেগমের স্বামী মামুন রশিদের ভাষ্য, ঘটনার দিন দুপুরে দরজার তালা খুলে বাসায় ঢুকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁর স্ত্রীকে দেখতে পান তিনি। উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক কোহিনূরকে মৃত ঘোষণা করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন মামুন রশিদ। তবে তিন মাস পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে ধানমন্ডি থানায় আসা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড।

এরপর কোহিনূর বেগমের ভাই সালাহউদ্দীন ম. রহমাতুল্লাহ বাদী হয়ে তাঁর ভগ্নিপতি মামুন রশিদ ও তাঁর পালিত কন্যা ফাইজা নূর-ই রশিদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন। ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট ধানমন্ডি থানা থেকে কোহিনুর বেগম হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ পিবিআইয়ের অর্গানাইজড ক্রাইমে স্থানান্তর করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের অর্গানাইজড ক্রাইমের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহীন মিয়া গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সার্বিক তদন্তে পাওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণ, সাক্ষীদের জবানবন্দি, স্থানীয় গণ্যমান্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য, পারিপার্শ্বিক, দালিলিক সাক্ষ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় কোহিনূর বেগমের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যার কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিনি আত্মহত্যা করেছেন উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।’

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পিবিআই সূত্র জানায়, বিয়ের পর ১৪ বছর নিঃসন্তান ছিলেন কোহিনূর–মামুন দম্পতি। একপর্যায়ে চার দিন বয়সী একটি শিশুকে দত্তক নেন তাঁরা। শিশুটির নাম রাখেন ফাইজা নূর রশিদ। এর প্রায় দুই বছর পর কোহিনূর বেগমের একটি ছেলেসন্তান হয়।

পিবিআই সূত্র বলছে, কোহিনূর বাইপোলার ডিজঅর্ডারে (একধরনের মানসিক ব্যাধি) ভুগছিলেন। এ কারণে তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। বাইপোলার ডিজঅর্ডারের কারণে রোগী বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন। রোগী চুপচাপ ও একাকী হয়ে যেতে পারেন। যাপিত জীবন নিরানন্দ ও নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করতে পারেন। গুরুতর অবস্থায় রোগী আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারেন। কোহিনূরের মধ্যেও এমন কিছু লক্ষণ ছিল। তিনি মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘আমি তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি, তা–ই না?’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহীন মিয়া বলেন, ঘটনার সময় কোহিনূর বেগম বাসায় একা ছিলেন। বাইপোলার ডিজঅর্ডার থেকেই তিনি আত্মহত্যা করেন। চিকিৎসকদের মত অনুযায়ী, এ ধরনের রোগীরা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কোহিনূর বেগমের স্বামী মামুন রশিদকে রিমান্ডে নিয়ে ও তাঁর পালিত মেয়ে ফাইজা নূর রশিদকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা শাহীন মিয়া।

তবে পিবিআইয়ের তদন্তের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে কোহিনূরের ভাই সালাহউদ্দীন ম. রহমতুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তিনি আদালতে নারাজি আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পিবিআই এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিল। মামুন রশিদ ও ফাইজা নূর পরিকল্পিতভাবে তাঁর বোন কোহিনূরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন বলে মনে করেন তিনি।

সালাহউদ্দীন আরও বলেন, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করায় দুই সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলেন না তাঁর বোন। এতে কোহিনূরের সন্তানেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থা দেখে তিনি চাকরি ছেড়ে সংসারে মনোযোগ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। তিনি বলেন, ফাইজার আচরণ এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে সামান্য কথাতেই তিনি কোহিনূর বেগমের গায়ে হাত তুলতেন। আর তাঁকে সমর্থন দিতেন মামুন রশীদ।