১৩৫ বছরের অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরি: ৩৮ হাজার বই, কিন্তু পাঠক কই?
রাজশেখর বসুর প্রবন্ধের বই ‘চলচ্চিন্তা’ কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশ হয় ১৯ শতকে। দাম ছিল তিন টাকা। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন—বাঙালি পাঠক আজকাল গল্প-কবিতা ছাড়া অন্য বিষয়ও পড়ছেন। সেই ‘চলচ্চিন্তা’র একটি কপি সযত্নে রাখা আছে পাবনা শহরের অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে।
শুধু চলচ্চিন্তা নয়, আরও অনেক প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহে আছে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির। ১৮৯০ সালের ৩০ জুলাই দুই কক্ষ দিয়ে শুরু হওয়া গ্রন্থাগারটি এখন দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সাদা চারতলা ভবনে। তবে ভবন বড় হলেও পাঠক কমে এসেছে। প্রতিদিন এখানে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ জন পাঠক আসেন, সংখ্যায় আগের তুলনায় যা অনেক কম।
শত বছরের বইপত্র-৩৮ হাজারের সংগ্রহ
বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষার অসংখ্য পুরোনো বই ও পাণ্ডুলিপিতে ঠাসা এই গ্রন্থাগার। যাদের বয়স শত শত বছর পেরিয়ে গেছে। এর সঙ্গে আছে নতুন বইয়ের সংগ্রহও। সব মিলিয়ে পাবনা শহরের আবদুল হামিদ সড়কের এই গ্রন্থাগারটি এখন ৩৮ হাজার বইয়ের বিশাল ভান্ডার।
গ্রন্থাগারের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল মতীন খান। তিনি বলেন, দিন দিন পাঠক কমে যাচ্ছে। শিক্ষক-গবেষকেরা আসেন না বললেই চলে। পেশাজীবীদেরও দেখা পাওয়া যায় না। তরুণদের মধ্যে যাঁরা আসেন, তাঁরা চাকরির প্রস্তুতির বই পড়েন।
১৮৯০ সালের ৩০ জুলাই দুই কক্ষ দিয়ে শুরু হওয়া গ্রন্থাগারটি এখন দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সাদা চারতলা ভবনে। তবে ভবন বড় হলেও পাঠক কমে এসেছে। প্রতিদিন এখানে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ জন পাঠক আসেন, সংখ্যায় আগের তুলনায় যা অনেক কম।
শিশুদের জন্য রঙিন কক্ষ
গত ৩১ অক্টোবর গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কক্ষে নিচু গোল টেবিল আর বসার জন্য মোড়া রাখা। এর সবগুলোই রঙিন। এই কক্ষটি শিশুদের পড়ার জন্য। তাই বইয়ের তাকে সাজানো বিভিন্ন শিশুতোষ বই।
অভিভাবকেরা সন্তানদের গ্রন্থাগারে নিয়ে এলে শিশুরা এসব বই হাতে নিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি খোলা থাকে সবার জন্য।
দুর্লভ যত সংগ্রহ
গ্রন্থাগারের কক্ষে বছরের পর বছর ধরে বই সাজিয়ে রেখেছেন আবদুল মতীন খান। ১৯৬৯ সালে তিনি এই গ্রন্থাগারের সঙ্গে যুক্ত হন। শুরুতে শিশু বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।
গ্রন্থাগারের একটি আলমারি খুলে আবদুল মতীন খান দেখালেন অমূল্য সব প্রাচীন বই। বইগুলো বাঁধাই করা; কিছু বইয়ের পাতা বয়সের ভারে লালচে হয়ে গেছে। কোনোটির দাম পাঁচ সিকা, কোনোটি ছয় আনা, কোনোটি চার টাকা। দুর্লভ এসব বইয়ের মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে প্রকাশিত বইও রয়েছে।
গ্রন্থাগারে থাকা প্রাচীন বইগুলোর লেখকের তালিকায় আছেন কালী প্রসন্ন ঘোষ, নিগমানন্দ, বিনয় কুমার সরকার, নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত, প্রমথ চৌধুরী, বিজয় চন্দ্র মজুমদার, মন্মথ নাথ ঘোষ, অধ্যাপক শ্রী রাধা কমল মুখোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র দত্ত, গোবিন্দ চন্দ্র দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শিশির কুমার ঘোষ, কিরণাবালা দাসী, অনুবাদক সতীশ চন্দ্র গুপ্ত, ভ্লাদিমির করলেস্কো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকের নাম।
আর প্রাচীন বইয়ের তালিকায় আছে স্বদেশ হিতৈষী, যোগীগুরু, বীণা, বিশ্ব-ভারত, লক্ষণ-চরিত, কস্তুরী (কাব্য), সীতা (নাট্য কাব্য), মহীরাবণের আত্মকথা, আমিত্বের প্রসার, সরস ও বিরস নাটক, রামায়ণবোধ বাল্মিকীর আত্মপ্রকাশ, চৈনিক পরিব্রাজক প্রথম খণ্ড, রাশিয়ার চিঠি, স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস, ওয়ালেসের জীবনবৃত্ত।
গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থাকা তিন টাকা দামের মহাজন সন্তোষনাথ শেঠ ‘সাহিত্যরত্ন’–এর লিখিত ও প্রকাশিত ‘বঙ্গে চালতত্ত্ব’ বইটির প্রকাশকাল বঙ্গাব্দ ১৩৩২ (খ্রিষ্টীয় ১৯২৬ সাল)। অশ্বিনীকুমার দত্তের ‘ভক্তিযোগ’-এর ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে (খ্রিষ্টীয় ১৯১১ সাল)। বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ‘যজ্ঞভস্ম’ প্রকাশিত হয় ১৩১১ বঙ্গাব্দে (খ্রিষ্টীয় ১৯০৫)। শিশির কুমার ঘোষের আড়াই টাকা মূল্যের ‘অমিয় নিমাই চরিত’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩১৮ বঙ্গাব্দে (খ্রিষ্টীয় ১৯১২ সাল)।
আবদুল মতীন খান বলেন, তবে এ বইগুলো পাঠকদের হাতে দেওয়া যায় না। এসব বই সংরক্ষণ করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নয় হাজার শিট পাণ্ডুলিপি
গ্রন্থাগারের অন্যতম আকর্ষণ শ্রী অরবিন্দ ঘোষ সভাকক্ষ। বাঙালি বিপ্লবী এই নেতা ১৯০৮ সালে পাবনায় এসেছিলেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে করা এই সভাকক্ষের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ৯ হাজার পাতার দুর্লভ পাণ্ডুলিপি।
এসব পাণ্ডুলিপি লেমিনিটিং করে রাখা হয়েছে। এসব পাণ্ডুলিপির মধ্যে আছে উপাখ্যান ও পৌরাণিক গল্প। এ ছাড়া আছে তালপাতায় হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি; আছে শত বছরের পুরোনো বাংলা পত্রিকা।
গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থাকা তিন টাকা দামের মহাজন সন্তোষনাথ শেঠ ‘সাহিত্যরত্ন’–এর লিখিত ও প্রকাশিত ‘বঙ্গে চালতত্ত্ব’ বইটির প্রকাশকাল ১৩৩২ বঙ্গাব্দ। অশ্বিনীকুমার দত্তের ‘ভক্তিযোগ’-এর ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩১৭ সালে। বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ‘যজ্ঞভস্ম’ প্রকাশিত হয় ১৩১১ সালে। শিশির কুমার ঘোষের আড়াই টাকা মূল্যের ‘অমিয় নিমাই চরিত’ প্রকাশিত হয় ১৩১৮ সালে।
হাতে লেখা পুঁথি অধিকাংশ পাঠোদ্ধার হয়নি
১৯৯০ সালে গ্রন্থাগার থেকে শতবর্ষ স্মরণিকা প্রকাশ হয়। এ স্মরণিকায় ‘কালের বলয়ে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি’ শিরোনামে একটি লেখা লেখেন মনোয়ার হোসেন জাহেদী (বর্তমানে প্রয়াত)।
তিনি লিখেছিলেন, ১৯৪১ সালে পাবনা কুচিয়ামারার কেদারনাথ রায় সরকার এই গ্রন্থাগারে তালপাতার ওপর লেখাসহ হাতে লেখা বাংলা ও সংস্কৃত অনেক মূল্যবান পুঁথি দান করেন। এর মধ্যে ১৮৮৮ সালের ‘ত্রৈতাষিক শিক্ষা বিবৃত্তি: অনুবাদ সহিতা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়া হলেও অধিকাংশ পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন আবদুল মতীন খান।
তাঁতিবন্দ জমিদার বংশের দানে শুরু যাত্রা
গ্রন্থাগারে ঢোকার আগেই চোখে পড়বে দেয়ালে টাঙানো আছে তাঁতিবন্দ জমিদার বংশের সদস্যদের পরিচয়। জানা গেছে, পাবনার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরীর ছেলে বরদা গোবিন্দ চৌধুরীর নিজের কোনো সন্তান ছিল না। তিনি একটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই ছেলে অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামেই এই গ্রন্থাগারটি ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৩ শতাংশ জমির ওপর দুই কক্ষের ভবন নিয়ে যাত্রা শুরু করা গ্রন্থাগারের উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ডি এইচ লিস। আর পরিচালনা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন পাবনা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর এফ বিজ।
পেট্রোম্যাক্স লাইট থেকে বিদ্যুৎ
গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সময় পাবনা পৌরসভার বয়স ১৪ বছর। তখনো এলাকায় বিদ্যুৎ আসেনি। তখন এক টাকায় পাওয়া যেত ১৩ সের চাল। তবু পাঠকদের সুবিধার জন্য লাগানো হয়েছিল ১৩ টাকা ৮ আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইট।
সন্ধ্যার পর এই পেট্রোম্যাক্স ইটের আলোয় পড়াশোনা করতেন পাঠকেরা। পরে ১৯৩৬ সালে ১০০ টাকা ব্যয়ে গ্রন্থাগারে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়া হয়।
পাবনার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরীর ছেলে বরদা গোবিন্দ চৌধুরীর নিজের কোনো সন্তান ছিল না। তিনি একটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই ছেলে অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামেই এই গ্রন্থাগারটি ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
অনুদানেই চলে গ্রন্থাগার
বছরের পর বছর অসংখ্য মানুষ এই বগ্রন্থাগারে অনুদান দিয়ে যাচ্ছেন। টানাপোড়েন থাকলেও সেই অনুদানের অর্থেই চলছে গ্রন্থাগার।
১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে গ্রন্থাগারের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়। এরপর শিল্পপতি ও স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী ১৯৯৮ সালে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর সহযোগিতায় শুরু হয় নতুন ভবন নির্মাণের কাজ। ২০০২ সালে বর্তমান এই ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। স্যামসন এইচ চৌধুরীর ছেলে, স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু এখন গ্রন্থাগারের সভাপতি। গ্রন্থাগারটির আজীবন সদস্যদের তালিকায় আছেন ১৬৫ জন।
নথি থেকে জানা গেছে, পাবনার সুধীজন থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা গ্রন্থাগারে বিভিন্ন সময় অনুদান দিয়েছেন। জমিদার অজিত গোবিন্দ চৌধুরী তাঁর বাবা হৃদয় গোবিন্দ চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষায় আলমারি কেনার জন্য ২৫ টাকা দান করেছিলেন। শহরের সুধীজনেরাই গ্রন্থাগারে আলোর ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া কেউ বৈদ্যুতিক পাখা, কেউ টাইপরাইটার দিয়ে সহায়তা করেছেন।
দিন দিন পাঠক কমে যাচ্ছে। শিক্ষক-গবেষকেরা আসেন না বললেই চলে। পেশাজীবীদেরও দেখা পাওয়া যায় না। তরুণদের মধ্যে যাঁরা আসেন, তাঁরা চাকরির প্রস্তুতির বই পড়েন।আবদুল মতীন খান, গ্রন্থাগারের মহাসচিব
১৯৩২ সালে পাবনা পৌরসভা গ্রন্থাগারের জন্য বার্ষিক সাত টাকা করে অর্থ মঞ্জুর করে। হলে সিনেমা দেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেও গ্রন্থাগারে অর্থ সহায়তা দিয়েছিল বাণী ও রূপকথা সিনেমা হল।
গ্রন্থাগারের মহাসচিব আবদুল মতীন খান বলেন, বর্তমানেও গ্রন্থাগারের জন্য অনুদান অব্যাহত আছে। বিভিন্ন দিবসসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও পালন করা হয়। গ্রন্থাগারের মাসিক খরচ কোনো মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজারে পৌঁছায়। সরকারের কাছ থেকে বছরে ৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়, এর মধ্যে গ্রন্থাগারের জন্য ২৫ হাজার টাকার বই কিনতে হয়।
১৩৫ বছরের পুরোনো এই গ্রন্থাগারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। আর্থিক সংকটের মধ্যেও বইয়ের সংগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু পাঠক কোথায়, সেই প্রশ্ন করেন আবদুল মতীন খান।