দক্ষিণের নৌপথে যাত্রী নিয়ে সরকারি নৌযান কবে চলবে

রাজধানী ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালফাইল ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের নৌপথে যাত্রী পরিবহন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। যদিও অনেকে নৌপথে যাত্রা করতে এখনো পছন্দ করেন। যাত্রী কমলেও এ নৌপথে চলছে বেসরকারি যাত্রীবাহী নৌযান। কিন্তু সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির কোনো যাত্রীবাহী নৌযান চলছে না। যাত্রীসংকট ও লোকসানের অজুহাতে এ সেবা বন্ধ রেখেছে তারা।

এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে–পরে ঢাকা থেকে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে বহু মানুষ নৌপথে যাতায়াত করেছেন। বেসরকারি লঞ্চগুলো এ সময় মুনাফা করেছে। তবে সেই সময়ও চলেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কোনো যাত্রীবাহী নৌযান বা লঞ্চ।

অবশ্য ঈদুল ফিতরে যাত্রীর চাপ সামাল দিতে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের নৌপথে লঞ্চের বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নৌযান প্রস্তুত রেখেছিল বিআইডব্লিউটিসি। কিন্তু সেটিও চলেনি। বিআইডব্লিউটিসি বলছে, বিআইডব্লিউটিএ চাইলে নৌযানটি সরবরাহ করা হতো।

ভোলা, লক্ষ্মীপুরের মতো যেসব এলাকায় এখনো সড়কে যাতায়াত কিছুটা কঠিন, সেসব এলাকায় লঞ্চের ভালো চাহিদা আছে। এসব নৌপথে লঞ্চ চলাচলে লাভ বেশি।
রেজিনুল কবির, সুরভী লঞ্চের মালিক

এখন ঢাকার সদরঘাট থেকে বিভিন্ন নৌপথে প্রতিদিন যাত্রীবাহী ৬০–৬৫টি লঞ্চ ছেড়ে যায়। বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) জয়নাল আবেদিন এ তথ্য জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন (শুক্রবার ও শনিবার) একটু বেশি লঞ্চ যায়, অন্য দিনগুলোয় কিছুটা কম চলাচল করে।

গত ঈদে ঢাকা থেকে ৪১টি নৌপথে যাত্রী পরিবহন করা হয়। তবে যাত্রী কমে যাওয়ায় ঢাকা–গলাচিপা, ঢাকা–তুষখালী, ঢাকা–আমতলী নৌপথ আপাতত বন্ধ আছে। বাকি ৩৮টি নৌপথে বেসরকারি নৌযান যাত্রী পরিবহন করলেও সরকারি কোনো সেবা নেই বলে জানালেন জয়নাল আবেদিন।

যাত্রী কমে যাওয়ায় লোকসানের কারণে আমরা নৌযানগুলোর চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আবার চালানোর উদ্যোগ নিচ্ছি।
মতিউর রহমান, বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান

যেভাবে চলছে বেসরকারি নৌযান

২ মে সন্ধ্যায় সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বহু যাত্রীর আনাগোনা। বরিশাল, চাঁদপুর, ভোলাসহ দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন নৌপথে যাত্রার অপেক্ষায় অনেকগুলো লঞ্চ। লঞ্চগুলোর ডেকে যাত্রীও বেশ। তবে গাদাগাদি নেই।

লঞ্চে কর্মরত ব্যক্তিরা জানালেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের নৌপথে যাত্রী পরিবহন বড় ধাক্কা খেয়েছে। তখন লঞ্চমালিকেরা সিদ্ধান্ত নেন, সব নৌপথে সব লঞ্চ চালু রাখা হবে। তবে প্রতিদিন লঞ্চ চলবে না। নির্দিষ্ট কয়েক দিন লঞ্চ চলবে।

সেতুটি চালুর পর লঞ্চমালিকদের আয় কমেছে ঠিক, তবে প্রতিদিন না চালানোয় এখনো তাঁরা লাভ করতে পারছেন বলে জানান লঞ্চে কর্মরত ব্যক্তিরা।

সুরভী লঞ্চের মালিক রেজিনুল কবির জানান, ঢাকা–বরিশাল নৌপথে এখন ১২টি লঞ্চ চলাচল করছে। তাঁদের লঞ্চ দুটি। এ দুটি মাসে ১২ দিন চলছে।

রেজিনুল কবির আরও বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে বরিশালে মাত্র চার ঘণ্টায় যাওয়া যায়। তাই এই নৌপথে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম। তবে ভোলা, লক্ষ্মীপুরের মতো যেসব এলাকায় এখনো সড়কে যাতায়াত কিছুটা কঠিন, সেসব এলাকায় লঞ্চের ভালো চাহিদা আছে। এসব নৌপথে লঞ্চ চলাচলে লাভ বেশি।

পড়ে আছে সরকারি নৌযান

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেতেন। বরিশাল নদীবন্দর
ফাইল ছবি: সাইয়ান

বিআইডব্লিউটিসির বহরে যেসব নৌযান আছে, তার মধ্যে সাতটি ঢাকা–বরিশালসহ দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন নৌপথে যাত্রী পরিবহন করত। এসব নৌযান হলো পিএস টার্ন, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা, এমভি বাঙালি, এমভি মধুমতী এবং এমভি সোনারগাঁও। এর মধ্যে পিএস অস্ট্রিচ ও এমভি সোনারগাঁও ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে। এমভি বাঙালি মেরামত করা হচ্ছে। বাকিগুলো ফেলে রাখা হয়েছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাবুবাজার সেতুসংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাদামতলী ঘাট। ঘাটে বিআইডব্লিউটিসির পন্টুন রয়েছে। ৫ মে গিয়ে দেখা যায়, বিআইডব্লিউটিসির পন্টুন বন্ধ। ফটকে সাইনবোর্ডে ঝুলছে, এটা সংরক্ষিত এলাকা।

এই ঘাটে লেপচা, মাহসুদ ও মধুমতী নৌযান নোঙর করা ছিল। নৌযান তিনটির কর্মীরা অলস সময় পার করছিলেন। কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। জানালেন, বিআইডব্লিউটিসির নৌযানগুলো সব ধরনের নিয়ম মেনে চলত। তাই এসব নৌযানে চলাচল তুলনামূলক নিরাপদ ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। আগে এসব নৌযান লোকসানে চললেও তা বেশ কম ছিল। সেতু চালুর পর লোকসান বেড়ে গেছে।

আরও পড়ুন

বিআইডব্লিউটিসির এসব নৌযান আবার যাত্রীসেবায় ব্যবহার করা হোক, এমনটাই চান কর্মীরা। তাঁরা বলছিলেন, অলস বসে থাকতে ভালো লাগে না। বসিয়ে রাখলে নৌযানেরও ক্ষতি।

বাদামতলী ঘাটে এমভি বাঙালি নৌযানটিও নোঙর করা ছিল। সম্প্রতি মেরামতের জন্য নেওয়ার সময় এই নৌযানে আগুন লাগে বলে জানালেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নৌপথে যাত্রীর স্বাচ্ছন্দ্য

২ মের রাত। সদরঘাটে এমভি শুভরাজ–৯ লঞ্চে ছিলেন মো. সোহেল। যাবেন বরিশালে। সেখানে মণিহারি পণ্য ও খেলনার দোকান তাঁর। কথায় কথায় বললেন, ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলেন। ব্যবসার টুকটাক কাজও সেরেছেন। এখন বাড়ি ফিরছেন।

আরও পড়ুন

সোহেল বলেন, সময় বেশি লাগলেও লঞ্চে যাতায়াত করতে তাঁর ভালো লাগে। লঞ্চে যে পরিবেশ, এমনটা কোথাও পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ভাড়াও এখন অনেকটা কম। লঞ্চের ডেকে বরিশালে যেতে আগে সাড়ে চার শ থেকে পাঁচ শ টাকা লাগত। এখন তিন শ টাকায় হয়ে যায়।

কেবিনের ভাড়া কিছুটা বেশি। তবে আগের তুলনায় এখন কম। ওই দিন এমভি শুভরাজের কেবিনে বরিশাল যাচ্ছিলেন ইকবাল আবদুল্লাহ। ভাড়া লেগেছে আড়াই হাজার টাকা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেবিনের ভাড়া কিছুটা বেশি। লঞ্চে সময়ও লাগবে বেশি। তবে নৌপথে আরামে যেতে পারব। সড়কে তা সম্ভব না। এ কারণে লঞ্চে যাতায়াত করি।’

আরও পড়ুন

সরকারি নৌযান চালুর আশা

পদ্মা সেতু চালুর পর প্রায় দুই বছর হতে চলল, ঢাকা থেকে সরকারি নৌযানে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন নৌপথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ আছে। আবারও যাত্রী নিয়ে এসব নৌপথে সরকারি নৌযান চলবে বলে আশা প্রকাশ করলেন বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমান।

মতিউর রহমান জানালেন, মেরামত শেষে এমভি বাঙালি ঢাকা–বরিশাল নৌপথে চালানোর কথা রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা–চাঁদপুরে পিএস মাহসুদ ও ঢাকা–কলকাতা নৌপথে এমভি মধুমতী চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

‘যাত্রী কমে যাওয়ায় লোকসানের কারণে আমরা নৌযানগুলোর চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা এখন আবার চালানোর উদ্যোগ নিচ্ছি’, বললেন মতিউর রহমান।

আরও পড়ুন