দাবা এল যেভাবে
রাজা চলবে আপনার ইশারায়। মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, সেনা—সবাই আপনার অধীনে। এবার শুরু যুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানে আপনার বুদ্ধির জোরেই হেরে যাবে প্রতিপক্ষ। এমন একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর বুদ্ধির মারপ্যাঁচের অনুভূতি সহজেই পাবেন দাবার বোর্ডে।
বুদ্ধির এই খেলা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে, পরিবারের সবাই মিলে খুব সহজেই আসর জমিয়ে ফেলা যায়। খেলতে খেলতে মনে যখন একটা চনমনে ভাব চলে আসে তখন মনে হয়, আচ্ছা এই খেলা আবিষ্কার করল কে? শুরুই–বা হলো কবে থেকে? কীভাবে? আসুন তাহলে, দাবা খেলা শুরুর গল্পটা জানা যাক।
প্রাচীন এই খেলার ইতিহাস বর্ণময়। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল দাবা খেলা। ষষ্ঠ শতাব্দীর আগেই ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় খেলাটির উৎপত্তি। লোককথা অনুযায়ী, লঙ্কেশ্বরী মন্দোদরী রাবণকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার জন্য এই খেলার সূচনা করেন। কিন্তু দাবার মতো একধরনের খেলার সন্ধান পাওয়া যায় প্রাচীন মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার অব্দে, সেই খেলার নাম ছিল ‘শতরঞ্জ’।
তবে ভারতবর্ষে ‘চতুরঙ্গ’ নামে দাবা খেলা শুরু হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর আগেই, তখনো গুপ্ত সাম্রাজ্য বিরাজমান। সেই সময় দাবাকে চতুরঙ্গ বলার কারণ খেলাটিতে হাতি, ঘোড়া, রথ ও সৈন্য—এই চারটি অংশ ছিল।
‘চতুর’ শব্দ থেকে এই ‘চতু’ আগত বলে অনেকে ধারণা করেন, যার অর্থ বুদ্ধিমান। তবে এর গ্রহণযোগ্য অর্থ হলো ‘চার’ থেকে ‘চতু’ এবং ‘দিক’ থেকে ‘অঙ্গ’ যোগে ‘চতুরঙ্গ’ (চারদিকে গমন–যোগ্য)। প্রাচীনকালে দাবায় ছিল চারটি অংশ—হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক সৈন্য। সেই থেকেও এই নামের উদ্ভব বলে মনে করা হয় (‘চতু’ মানে ‘চার’ এবং ‘অঙ্গ’ মানে ‘অংশ’)। কিন্তু চতুরঙ্গ খেলাটা ‘দাবা’ হয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে সাতসমুদ্র। লেগেছে অনেক সময়।
ভারত থেকে সময়ের পরিক্রমায় খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে ইরানে। এরপর দাবা খেলার চর্চা শুরু হয় দক্ষিণ ইউরোপে। আধুনিক দাবার শুরু সেখানেই। সে সময় পারস্যের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল বেশ জমজমাট। পারস্যের বণিকেরা খেলাটি দেখেন এবং বেশ পছন্দ করে ফেলেন। তাঁরা নিজ উৎসাহে খেলাটি শিখে ফেলেন। পরে পারস্যে এই খেলার কিছুটা উন্নতি হয়, ‘চতুরঙ্গ’ নামটা বদলে সেটিই হয়ে ওঠে ‘শতরঞ্জ’।
আসলে নামটা বদলে গেছে বলাটা ঠিক যুক্তিযুক্ত হলো না। পারস্য বর্ণমালায় ‘চ’ এবং ‘গ’ না থাকায় সেটাই কালক্রমে ‘শ’ এবং ‘জ’-তে পরিণত হয়।
পারস্য থেকে শতরঞ্জ আরও নানাভাবে ইউরোপে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে ১২ শতকে পারস্যে সালাউদ্দিনের শাসনামলে ইউরোপের ক্রুসেডাররা জেরুজালেম রক্ষার জন্য দলে দলে ভিড় জমান পারস্যে। দীর্ঘদিন পারস্যে থাকতে থাকতে তাঁরা পারস্যের অনেক কিছুই আমদানি করতে থাকেন ইউরোপে।
এভাবে মন প্রফুল্ল করা, বুদ্ধির এই খেলাটি ইউরোপ ও রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখানেও সে নতুন নাম পায় ‘চেস’; যা পুরোনো ফরাসি ভাষা ‘echec’ (অর্থ চেক) থেকে উদ্ভূত। এ সময় শুধু খেলাটির নাম নয়, আরও অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসে। ইউরোপেই দাবায় প্রথম বিশপ (হাতি) যুক্ত হয়। আরও পরে যোগ হয় রানি। পরে এই খেলা ইউরোপীয়দের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, জাতি নয়, ব্যক্তি হিসেবে দাবা খেলার আবিষ্কারক কে?
কথিত আছে, রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী যুদ্ধে নিবৃত করার জন্য রাবণের সঙ্গে দাবা খেলতেন। পুরাণের ভাষায় তাঁকেই দাবার আবিষ্কারক বোঝানো হয়েছে। তবে ‘আধুনিক দাবার জনক’ বলা হয় উইলহেম স্টেইনিজকে।
জনপ্রিয় খেলাটির জন্য নানা রকম বোর্ড পাওয়া যায়। ছোট-বড়, কাগজের কিংবা টিনের। সব ধরনের বোর্ডই জনপ্রিয়। তবে ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন খেলা যায় ডিজিটাল দাবাও। মুঠোফোনে অবসর সময়ে আপনিও মেতে উঠতে পারবেন বুদ্ধির শাণ দেওয়ার এই খেলাটিতে।
বিজ্ঞাপন বার্তা