রাজধানীতে টার্মিনালের বাইরে কাউন্টার নয়

যানজট নিরসন ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে আগামী ১ এপ্রিল থেকে টার্মিনালের বাইরে আন্তজেলার বাস কাউন্টার রাখবে না ডিটিসিএ।

ফাইল ছবি

রাজধানীতে টার্মিনালের বাইরে আন্তজেলার কোনো বাস কোম্পানির কাউন্টার থাকবে না। যানজট নিরসন ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে আগামী ১ এপ্রিল থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চায় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।

বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির (ফ্র্যাঞ্চাইজির) মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি প্রবর্তনসংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির ২৫তম সভায় (গত ১৩ ডিসেম্বর) এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১৭ জানুয়ারি গণমাধ্যমে একটি গণবিজ্ঞপ্তি ছাপিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গতকাল পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি।

বাসমালিকেরা ডিটিসিএর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এটি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, এ নিয়ে তাঁদের সংশয় রয়েছে। কারণ, রাজধানীর ভেতরে থাকা আন্তজেলা বাস টার্মিনালে পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এখনই টার্মিনালগুলোতে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি বাস থাকছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিটিসিএর সিদ্ধান্ত যানজট নিরসনে কার্যকরী নয়। গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় উপরিভাগের সমস্যা দেখে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিকড় থেকে সমস্যা খুঁজে বের করে সিদ্ধান্ত না নিলে কোনো লাভ হবে না।

যেভাবে চলছে এখন

মূলত রাজধানীর কমলাপুর, ফকিরাপুল, আরামবাগ, মালিবাগ, কলাবাগান, শ্যামলী এবং কল্যাণপুর এলাকায় দূরপাল্লার বিভিন্ন গন্তব্যের বাস কোম্পানির কাউন্টার রয়েছে।

বাসমালিকদের দাবি, সকাল ৭টার আগে এবং রাত ১০টার পর টার্মিনালের বাইরের কাউন্টার থেকে সরাসরি যাত্রী ওঠানো হয়। বাকি সময়ে যাত্রীদের নিজ দায়িত্বে টার্মিনালে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু বাস কোম্পানি নিজ দায়িত্বে কাউন্টার থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত পরিবহনসেবা দিয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ যাত্রীকে বাকি সময়ে নিজ দায়িত্বে টার্মিনালে যেতে হয়।

সভায় উপস্থিত একটি সূত্র বলছে, কাউন্টারের সামনে বিশৃঙ্খল ও যত্রতত্রভাবে বাস দাঁড় করিয়ে রেখে যাত্রীদের ওঠানো হয়। অনেক কাউন্টারের সামনে দীর্ঘক্ষণ বাস পার্কিং অবস্থায় থাকে। এতে সড়কে যানজট লাগে। যানজট নিরসনেই কাউন্টারগুলোকে টার্মিনালের ভেতরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দূরপাল্লার যাত্রীদের টার্মিনালের ভেতর থেকে বাসে ওঠাতে হবে। এতে বাস নেওয়া কিংবা রাখা লাগবে টার্মিনালের ভেতরেই।

টার্মিনালে অপর্যাপ্ত জায়গা

ঢাকায় আন্তজেলা বাস টার্মিনাল রয়েছে তিনটি। ঢাকা উত্তর সিটিতে মহাখালী ও গাবতলী এবং দক্ষিণ সিটিতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল। দুই সিটির কর্মকর্তারা জানান, টার্মিনাল তিনটিতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বাস ডিপো বা পার্ক করে রাখার জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে মহাখালীতে প্রায় ৩০০, গাবতলীতে প্রায় ৬০০ ও সায়েদাবাদে প্রায় ৫০০টি।

এর মধ্যে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের সংস্কার ও উন্নয়নকাজ চলছে, যা আগামী মার্চে শেষ হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৬০টি কোম্পানির বাস চলে। এসব কোম্পানির প্রায় ছয় হাজার বাস রয়েছে। এর মধ্যে হানিফ, শ্যামলী, এনা, সৌদিয়া, এসআর, গ্রিনলাইন—এসব বড় কোম্পানিরই বাস আছে প্রায় তিন হাজার। এই হিসাবে টার্মিনালের ধারণক্ষমতার প্রায় চার গুণ বাস রয়েছে।

মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, টার্মিনালগুলো ১৯৮৪ সালে নির্মাণের সময় যে ধারণক্ষমতা ছিল, এখনো তা-ই আছে। জায়গা না বাড়ালে গাড়িগুলো কীভাবে চলবে?

তবে ডিটিসিএর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে, ঢাকার বাইরে টার্মিনাল করা ছাড়া বিদ্যমান টার্মিনালে জায়গা হবে না। তাই ঢাকার বাইরে তিনটি টার্মিনাল করার পর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে ভালো।

বাস-বে অকার্যকর

টার্মিনালে বাস ডিপোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাস-বের জায়গা। অর্থাৎ যে জায়গায় বাস এসে দাঁড়াবে এবং যাত্রীদের গাড়িতে তুলবে। দুই সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনালের বাস-বেগুলো কার্যত অচল হয়ে গেছে। তবে সায়েদাবাদ টার্মিনালের বাস-বে নতুন করে সংস্কার ও নির্মাণ করা হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৫-এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের জন্য দুটি, মহাখালী, দক্ষিণবঙ্গ, সিলেট ও কুমিল্লার জন্য একটি করে মোট ছয়টি বাস-বে তৈরি ও সংস্কার করা হচ্ছে। এসব বাস-বেতে একসঙ্গে মোট ৬৬টি বাস যাত্রীর জন্য দাঁড়াতে পারবে।

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, টার্মিনাল মূলত বাস ডিপোতে পরিণত হয়েছে। অথচ টার্মিনালে মূলত বাস আসবে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে চলে যাবে। এই পদ্ধতিকে সক্রিয় করতে পারলে জায়গা নিয়ে বাসমালিকদের যে শঙ্কা, সেটি থাকবে না।

পেশাদার ইউনিট গঠনের পরামর্শ

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অপেশাদার ও অনভিজ্ঞদের রুট পারমিট দেওয়ায় রুট খণ্ডিত-বিখণ্ডিত হয়েছে। যে অনুমতি চাইছে, তাকেই দেওয়া হচ্ছে। আর বাস নিয়ে তারা টার্মিনালে বসে থাকছে।

সামছুল হক আরও বলেন, গণপরিবহন সেবা বড় কোম্পানি কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক হলে ভালো হতো। তারা নিজেরাই টার্মিনাল করত। এ ছাড়া বড় বিনিয়োগ করে বাস কিনে তারা কখনো বসিয়ে রাখত না।

গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে সুনির্দিষ্ট ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, মূল সমস্যা উদ্‌ঘাটন করে সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মেয়র দপ্তরে গণপরিবহনের জন্য পেশাদার ইউনিট গঠনের পরামর্শ দেন সামছুল হক।