প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ: অতিরিক্ত সচিব নন, চেয়ারম্যান হবেন ‘উপযুক্ত’ কেউ

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরছবি: নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। বন্দরটি পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এর প্রস্তাবিত নাম ‘মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ’। এ জন্য একটি খসড়া আইনও তৈরি করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত এই কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবকে চেয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি সংস্থা থেকে আপত্তি আসে। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে কোনো অতিরিক্ত সচিবকে না দিয়ে একজন ‘উপযুক্ত’ ব্যক্তিকে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি।

এর ফলে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে খসড়া আইনে পরিবর্তন আনছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী, কোনো অতিরিক্ত সচিব নন, প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হবেন একজন ‘উপযুক্ত’ ব্যক্তি।

গত ৩০ নভেম্বর এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে সূত্র জানায়। সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোস্তফা কামাল সভাপতিত্ব করেন।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মাতারবাড়ী। সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ জোরেশোরে চলছে।

গত ১১ নভেম্বর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন করা হয়। সেদিন বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করা হয়।

সূত্র জানায়, মাতারবাড়ী বন্দর পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত এই কর্তৃপক্ষ কীভাবে চলবে, তা ঠিক করতে খসড়া আইন করা হয়। খসড়া আইনটি নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর সচিবালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়
ছবি: মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

খসড়া আইনটির ৭ (১ ক) ধারায় বলা হয়, সরকার একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেবে, যিনি অতিরিক্ত সচিব বা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্য হবেন।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ৩০ নভেম্বরের আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল এই ধারাটি সংশোধনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে সরকার একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে পারে। পদমর্যাদা অনুযায়ী তাঁর সব সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত হবে।

খসড়া আইনের ৭ (১ খ) ধারায় বলা হয়, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিম্নে নয়, এমন তিনজন সার্বক্ষণিক সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হবেন। এই ধারাটিও সংশোধনের প্রস্তাব দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। তিনি সার্বক্ষণিক সদস্য হিসেবে তিনজনের পরিবর্তে চারজন নিয়োগের প্রস্তাব দেন।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ সোহায়েল গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈঠকে আমার মতামত জানিয়েছি। আমি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি সংস্থায় কর্মরত। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারি না। আমি যা বলার বৈঠকেই বলেছি।’

খসড়া আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বন্দর) বিধায়ক রায় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, খসড়া আইনে চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত সচিব থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তা সংশোধন করা হচ্ছে। এই পদে সরকার ইচ্ছা করলে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারবে। সেটা সরকারি-বেসরকারি যেকোনো জায়গা থেকে হতে পারে। তবে খসড়া আইনটি আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তারপর চূড়ান্ত হবে।

প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে সরকারের অতিরিক্ত সচিব থেকে কাউকে নিয়োগ দিলে কী সমস্যা—জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একটি বন্দরে শুধু বন্দর পরিচালনার বিষয় থাকে না। সেখানে সমুদ্রবিষয়কসহ আরও অনেক কারিগরি বিষয় থাকে, যা একজন অতিরিক্ত সচিবের পক্ষে করা কঠিন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অতিরিক্ত সচিবকে নিয়োগ দিয়ে কেন এই পদটি প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যেই রেখে দিতে হবে? চেয়ারম্যান পদে অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন। সরকার চাইলে তাঁদের আনতে পারে।’

আইন হলে মাতারবাড়ী হবে দেশের চতুর্থ বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর আগে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে সরকার। জানা যায়, চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আইনে চেয়ারম্যান পদে সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা আছে। সেখানে অতিরিক্ত সচিবকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা নেই।

বর্তমানে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা—এই তিনটি বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে নৌবাহিনী থেকে আসা কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল গোলাম সাদেক।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদেও নৌবাহিনী থেকে কোনো কর্মকর্তা আসতে পারেন।