শাসক দলের বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারেন

‘বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা: চিন্তক-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে রাষ্ট্রচিন্তা। ঢাকা, ১৯ আগস্ট
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

শাসক দলের অনুসারী বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্লজ্জভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারেন। কিন্তু সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে ঐক্য নেই।

‘বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা: চিন্তক-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে রাষ্ট্রচিন্তা।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জনগণ খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ভূমিকা রাখছেন না। কারণ, তাঁরা নানা সুযোগ-সুবিধায় আটকে রয়েছেন। এখন নতুন বুদ্ধিজীবী দরকার।

মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে ঐক্য ও সত্য বলার ক্ষেত্রে অনৈক্যের কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘একটা জঘন্য মিথ্যা কথা বলার ব্যাপারে তাঁরা (সরকারের অনুসারী বুদ্ধিজীবী) যে পরিমাণ ঐক্যবদ্ধ থাকেন, একটি সত্য বলার ব্যাপারেও আমরা এত ঐক্যবদ্ধ থাকি না। আমরা মনে করি, এটা বললে কী ভাববে। ওরা তো চিন্তা করে না কী ভাববে।’
আসিফ নজরুল বলেন, ‘তাঁরা চিন্তা করেন না, আপনি এত চিন্তা করেন কেন? এই সাহসিকতা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রদর্শন করতে হবে।’

দেশে বড় কোনো বুদ্ধিজীবী নেই উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, স্বৈরাচার ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেক সোজা। কারণ, সে খুবই স্পষ্টভাবে শয়তান। কিন্তু একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল যদি শয়তান হয়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা বেশি কষ্টের।

ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এ দুই বিষয়ে কবি, লেখক, সাহিত্যিক, চিন্তক, সাংবাদিকসহ সবার ঐকমত্য থাকতে হবে বলে মনে করেন সাহিত্যিক ও সম্পাদক রাখাল রাহা। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র যে মতাদর্শ ও চিন্তাধারায় পরিচালিত হোক না কেন, আমাদের এ দুই জিনিস লাগবে। এ দুই জিনিস যদি না থাকে, তাহলে আজ যদি শিক্ষায় সর্বনাশ করে, স্বাস্থ্যে সর্বনাশ করে, আদালতে সর্বনাশ করে—কোথাও আমরা কিছু করতে পারব না, বলতে পারব না।’

মানুষের কথা বলার, চিন্তা করার, মতপ্রকাশের অধিকার এবং দেশে যে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের সংগ্রাম চলছে, সেগুলো নিয়ে বড় কোনো প্রকাশ্য কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব দেন লেখক ও সাংবাদিক ফিরোজ আহমেদ। তিনি বলেন, শওকত ওসমান ষাটের দশকে বুদ্ধিজীবী হতে পেরেছিলেন। কারণ, তিনি ‘ক্রীতদাসের হাসি’ লিখতে পেরেছিলেন। শওকত ওসমানরা আজ ওটা লিখতে পারবেন না; কারণ, তাঁরা নানাভাবে সুযোগ-সুবিধায় আটকা পড়েছেন।

ফিরোজ আহমেদ আরও বলেন, প্রতিটি যুগ তার চাহিদা অনুযায়ী নতুন বুদ্ধিজীবী তৈরি করে। তাই পুরোনো বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকিয়ে না থেকে বর্তমান সময়ের বিষয় নিয়ে কথা বলার রেওয়াজ তৈরি করতে হবে।

নগর–পরিকল্পনাবিদ খন্দকার নিয়াজ রহমান বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি যে এরশাদকে ভালো বলেছেন। লেখক, শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা ব্যক্তিগত ও সংঘবদ্ধভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু এখন আমরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধভাবে নিষ্ক্রিয়।’

ফ্যাসিবাদী শাসক ও স্বৈরশাসকের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে নিয়াজ রহমান বলেন, স্বৈরশাসক শুধু বল প্রয়োগ করে দেশ শাসন করে। আর ফ্যাসিবাদী শাসক একটা আখ্যান তৈরি করে। তার একটা গল্প থাকে। তার পেছনে আদর্শের ও বুদ্ধিজীবীদের একটা সক্রিয় সমর্থন থাকে। তিনি বলেন, দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গল্প আছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের গল্প আছে, সংবিধানের গল্প আছে। আশ্চর্যভাবে যে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে তার ঠিক উল্টো কাজ করে, সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে কাজ করে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও লেখক গোলাম শফিক। সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক আর রাজী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোশরেকা অদিতি হক, লেখক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ, লেখক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন, সংগঠক আবুল কালাম আল আজাদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।