জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষিতে গুরুত্ব 

‘টেকসই পুষ্টিনিরাপত্তায় জলবায়ু–সহিষ্ণু কৃষি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জানো প্রকল্প ও প্রথম আলো

জানো প্রকল্প ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘টেকসই পুষ্টি নিরাপত্তায় জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) মার্গারিতা ক্যাপালবি, কবিতা বোস, মোহাম্মদ হাসান শাহরিয়ার কবির, মাহবুবুর রহমান ও আমানুর রহমান। গতকাল কক্সবাজারে একটি হোটেলে
ছবি: জুয়েল শীল

বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ প্রতিবছর অন্তত ১ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক চাষযোগ্য জমিতে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না।

টেকসই খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় জলবায়ুসহিষ্ণু ফসলের বীজ ও জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে। আর আবাদযোগ্য কোনো জমি পতিত রাখা যাবে না। এসব নিশ্চিত করা গেলে দেশের খাদ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।

গতকাল সোমবার দুপুরে ‘টেকসই পুষ্টিনিরাপত্তায় জলবায়ু–সহিষ্ণু কৃষি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। 

জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম (জানো) প্রকল্প এবং প্রথম আলো এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সহযোগিতায় ছিল কেয়ার বাংলাদেশ, প্ল্যান বাংলাদেশ ও ইকোসোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। 

কক্সবাজারের সায়মন হোটেলের সম্মেলনকক্ষে গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি কাউন্সিলের (বিএনসিসি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে কৃষকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তাঁদের পুষ্টিমান। কৃষকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর উন্নতিতে নজর দিতে হবে।

ফসল উৎপাদনে আগের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় বলে জানান মোহাম্মদ হাসান শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের নীতি ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি ফসল উৎপাদনের জন্য অঞ্চলভিত্তিক ম্যাপ বা মানচিত্র তৈরি করার পরামর্শ দেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের গবেষণা পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০০৬ সালে জাতীয় খাদ্যনীতি করা হয়েছিল। সরকার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে তা জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নীতি ২০২০ নামকরণ করেছে। এ নীতি বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, পুষ্টির ক্ষেত্রে বরাদ্দ কম। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে দাতা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

মহামারি করোনা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলে জানান মাহবুবুর রহমান। এ অবস্থায় দেশেই নিজস্ব জাতের ধান, গমসহ শাকসবজির উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে সবার নজর দিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সূচনা বক্তব্যে প্ল্যান বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। বৈশ্বিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। এর পেছনে অবদান জনসাধারণের। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা একসময় খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। 

ইইউ ডেলিগেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মার্গারিতা ক্যাপালবি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় ২০ বছর ধরে কাজ করছে। এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করে আসছে। খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার বিষয়ে তাঁদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা। এ সমস্যায় শুধু বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে না, পুরো বিশ্ব করছে। তবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে, এবারও তা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক (ইআরপিপি) আমানুর রহমান। সঞ্চালকের বক্তব্যে তিনি বলেন, জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর জোর দেন।

গোলটেবিল বৈঠকে জানো প্রকল্পের তথ্য–উপাত্ত উপস্থাপনের সময় কেয়ার বাংলাদেশের পরামর্শক মারুফ আজম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক দেশে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছে। তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। তিনি জানান, জানো প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে চাষাবাদের জন্য ১ হাজার ১৪০টি প্রদর্শন প্লট তৈরি করা হয়েছে। সেখানে জলবায়ুসহিষ্ণু ধান, শাকসবজি চাষ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের ৩০৩ জন এবং ১ হাজার ১২৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চার থেকে সাড়ে চার বছর ধরে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে অনেক পরিবার উপকৃত হয়েছে। তাঁদের দেখাদেখি পাড়া–প্রতিবেশীরাও জলবায়ুসহিষ্ণু চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

জানো প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ দলনেতা মিজানুর রহমান বলেন, কৃষকদের জন্য তথ্যপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। কখন নতুন বীজ আসছে, তা কোথায় পাওয়া যাবে, সে তথ্য তাঁদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষকদের সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য দিতে হবে।

বাংলাদেশে বছরে ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে জানিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি কাউন্সিলের উপপরিচালক মো. আখতার ইমাম বলেন, নগরায়ণের কারণে জমির পরিমাণ কমছে। নদীভাঙনের কারণে মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে ফেলছে। তাঁদের শহরে ঠাঁই নিতে হচ্ছে। এ বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আর খাদ্য উৎপাদন বাড়াত হলে খরা, বন্যা, লবণাক্তসহিষ্ণু ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে হবে। আর খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা টেকসই করতে হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে যেমন ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান পরিচালনা করা হয়, তেমনি ভেজাল বীজ বিক্রি বন্ধেও এ ধরনের অভিযান পরিচালনার আহ্বান জানান জানো প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. গোলাম রব্বানী। 

রংপুর জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা হুমায়রা মণ্ডল বলেন, দেশের প্রতিটা জায়গা যেন আবাদযোগ্য হয়। কোনো জায়গা যাতে অনাবাদি পড়ে না থাকে, সে জন্য তাঁরা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।

জানো প্রকল্পের উপকারভোগী মোহিনী কান্ত রায় জানান, তাঁর উৎপাদিত কেঁচো সারের চাহিদা বেড়েছে। আগে যেখানে কেজিপ্রতি ৪ টাকা পেতেন, এখন পান ১০ টাকা করে। উৎপাদনের পরিমাণও বেড়েছে।

উপকারভোগী মুক্তা বেগম বলেন, তাঁর জমিতে এখন যে পরিমাণ শাকসবজি উৎপাদন হয়, তা দিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটে যায়। আবার বাড়তি শাকসবজি বাজারে বিক্রি করে টাকা সঞ্চয় করতে পারছেন।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার, এসিআই অ্যানিমেল হেলথের ডেপুটি সেলস ম্যানেজার কামরুল হুদা, বিএনসিসির উপপরিচালক নুসরাত জাহান, জানো প্রকল্পের কারিগরি কর্মকর্তা নিহার কুমার প্রামাণিক, নীলফামারীর কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, জানো প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক পড়শিয়া রহমান, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।