বেআইনি আটকের আইনি প্রতিকার

আইন–অধিকার
প্রতীকী ছবি

সাদিক হাসান (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি কলেজের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, এ ছাড়া একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারও সদস্য। বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করেন এবং মানববন্ধন–প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। গত কোরবানির ঈদের ছুটিতে সাদিক তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে যান। তাঁর নামে দেশের কোথাও কোনো মামলা না থাকলেও ঈদের পরদিন সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি সাদিককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে তিনি ‘নিখোঁজ’। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর সন্ধান পাননি।

ভুক্তভোগীর নাম–ঠিকানা, ঘটনার সময় পরিবর্তন করা হলেও এটা একটি সত্য ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়ই ঘটে। এগুলোকে বেআইনি আটক বলা হয়। বেআইনি আটক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা যেমন হয়, তেমনি অপরাধীদের দ্বারাও হতে পারে। আটক ব্যক্তিকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনাও ঘটে। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে আটক ব্যক্তিকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয়জন ব্যক্তি এভাবে ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। তাঁদের একজনেরও ফেরত আসার খবর পাওয়া যায়নি।

কারও বিরুদ্ধে মামলা না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী যে কাউকে যুক্তিসংগত কারণে গ্রেপ্তার করতে পারে। ৯টি কারণে এ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক সময়ই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রয়োগের অভিযোগ পাওয়া যায়। কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে নিকটবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণের বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটা মানে না। কোনো ব্যক্তিকে কয়েক দিন আগে গ্রেপ্তার করা হলেও কাগজে-কলমে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দিয়েছেন, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অধস্তন আদালতগুলোর জন্য মেনে চলা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ, ৫৪ ধারায় ওয়ারেন্ট ছাড়া আটকের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত বিধানগুলোর পরিপন্থী।

বেআইনি আটকের প্রতিকার

বেআইনি আটকের ক্ষেত্রে প্রথমে নিকটবর্তী থানায় জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা করা যেতে পারে। আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারানুযায়ী আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারে সার্চ ওয়ারেন্ট বা তল্লাশি পরোয়ানা জারি করতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারায় বলা আছে, কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে আটক রাখেন, তাহলে যিনি বা যাঁরা আটক রেখেছেন, নিশ্চিত জানা যাবে, তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধে এই তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করা যাবে। বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য এ বিধান করা হয়েছে।

আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টে বিভাগে রিট (রিট অব হেবিয়াস কর্পাস) করা যেতে পারে। আদালত আটক ব্যক্তিকে আদালতের সামনে উপস্থিত করার আদেশ দিতে পারেন। সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেআইনিভাবে কাউকে আটক করলে এবং তাঁর সন্ধান পাওয়া না গেলে রিট অব হেবিয়াস কর্পাস করা হলে প্রতিকার পাওয়া যায়। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারা বা বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২ (২) (বি)(অ) ধারানুযায়ী এ ধরনের রিট দায়ের করা হয়। রিট করা হলে আটক ব্যক্তিকে আদালতের সামনে উপস্থিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদালত আদেশ দিতে পারেন।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে সংবিধান। সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মুক্ত, স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে। এটি একটি মৌলিক অধিকার। নাগরিকের এ অধিকার রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

সোলায়মান তুষার আইনজীবী