মামলা ঝুলে আছে বছরের পর বছর

মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব কেন

বিচারক-সংকট, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের আদালতে অনুপস্থিতি, সমন জারিতে দেরি, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া।

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকায় অবস্থিত শ্রম আদালতফাইল ছবি

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক বৃষ্টি দাশ। চাকরিচ্যুতির পর পাওনা মজুরি চেয়ে শ্রম আদালতে মামলা করেন ২০১৯ সালে। সেই মামলা এখনো ঝুলে আছে। গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী আর চট্টগ্রাম শহর আসা–যাওয়ায় ক্লান্ত তিনি। বৃষ্টি দাশ বলেন, ‘এখন আর চট্টগ্রাম আসি না। মামলার খোঁজও নিই না। বিচারের আশাও করি না।’

বৃষ্টির মতো হাজারো শ্রমিকের মামলার বিচার ঝুলে আছে বছরের পর বছর। অথচ সর্বোচ্চ ১৫০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।

আইনজীবীরা জানান, শ্রম আদালতে মামলা করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় পাওয়া যাবে। শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ঢাকায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়।

এখন ২ হাজার ২৪টি মামলা বিচারাধীন। পাঁচ শতাধিক মামলা চার থেকে পাঁচ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি।

আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচারক–সংকট, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের আদালতে অনুপস্থিতি, সমন জারিতে দেরি, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে দেরির কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে।

চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে এখন ২ হাজার ২৪টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে ১ হাজার ৪৭৯টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৫৪৫টি। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক মামলা রয়েছে, যেগুলো চার থেকে পাঁচ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি। দুটি আদালতে এক বছরে (এপ্রিল ২০২৩ থেকে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত) নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৭৫টি।

বৃষ্টি দাশ নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার নাসিরাবাদ এলাকায় ডাফ, পি, পি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পোশাক কারখানায় হ্যাঙ্গার শাখায় অপারেটর হিসেবে স্থায়ী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৮ সালের ১১ জুলাই হঠাৎ করে মৌখিক নির্দেশে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর বকেয়া মজুরি, অর্জিত ছুটির মজুরিসহ পাওনা ৫১ হাজার ৪২০ টাকার জন্য ডাকযোগে মালিক পক্ষকে চিঠি দেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। পরের বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় শ্রম আদালত চট্টগ্রামে মামলা করেন। এতে কারখানার চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনকে প্রতিপক্ষ করা হয়। মামলা করার পর শ্রম আদালত থেকে প্রতিপক্ষদের কাছে নোটিশ যায়। কিন্তু প্রতিপক্ষ কোনো সাড়া দেয়নি। আদালতে হাজিরও হয়নি।

এভাবে তিন বছর কেটে যায়। ২০২২ সালের ৩ এপ্রিল বাদীর একতরফাভাবে সাক্ষ্য শুরু হয়। বাদী ওই দিন আংশিক সাক্ষ্য দেন। পরে বাদী আর ধার্য দিনে হাজির হননি। আইনজীবীর মাধ্যমে বারবার সময়ের আবেদন করেন। শেষ গত সোমবার এই মামলার ধার্য দিনে প্রতিপক্ষের আইনজীবী একতরফা সাক্ষী না নেওয়ার আবেদন করেন। একই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের জবাব দাখিল করেন আদালতে। আদালত আগামী ২২ জুলাই আপসের জন্য দিন ধার্য রেখেছেন।

এত দিন পরে কেন জবাব দাখিল করলেন জানতে চাইলে ডাফ, পি, পি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মালিকপক্ষ ও আইনজীবীদের মামলা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ দেরি করে না।

তবে বাদীর আইনজীবী এস এম সাহাব উদ্দিনের বলেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে তাঁর বাদী মামলা পরিচালনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণেই বারবার সময় আবদন করা হয়।

শ্রমিকদের পাওনাসহ নানা দাবি সহজে আদায়ের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে এগোনোর পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহীন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এতে সময় কম লাগবে। দুর্ভোগ কম হবে। মালিক-শ্রমিক দুজনই উপকৃত হবেন।