টিকা নিলেই জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ছয় লাখ নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তাঁদের মধ্যে মারা যান প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। কিন্তু জরায়ুমুখের ক্যানসার পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য। জরায়ুমুখ-ক্যানসারের টিকা নিলেই এর সংক্রমণ রোধ করা যায়।

এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় এ কথা উঠে আসে। জানুয়ারি মাস জরায়ুমুখের ক্যানসার-সম্পর্কিত সচেতনতার মাস। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি এ আলোচনার আয়োজন করে।

নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালের রেডিয়েশন অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট জান্নাতুল ফেরদৌস এবং একই বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট রুবামা করিম।

গত বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই জরায়ুমুখে ক্যানসারের বিষয়ে ধারণা দিতে গিয়ে রুবামা করিম বলেন, প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মৃত্যুবরণ করেন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এটি বিশ্বের চতুর্থ ‘কমন ক্যানসার’। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৮ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় সাড়ে আট হাজার নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যান প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার।

এই ক্যানসারের ঝুঁকিগুলো কী কী, এমন প্রশ্নের জবাবে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, এটি পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য একটি ক্যানসার। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণে এটি হয়। জরায়ুমুখের ক্যানসারের টিকা নিলেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা যায়। এ ছাড়া সময়মতো স্ক্রিনিং করে রোগ শনাক্ত করে ফেলতে পারলে এই ক্যানসার শতভাগ নিরাময় করা সম্ভব।

জরায়ুমুখের ক্যানসারের লক্ষণগুলো কী কী, উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে রুবামা করিম বলেন, মাসিকের রাস্তায় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। দুর্গন্ধযুক্ত নিঃসরণ হতে পারে। তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথাও দেখা দিতে পারে।

রুবামা করিম আরও বলেন, মেটাস্টেটিক সিম্পটমগুলো হতে পারে তলপেটে ব্যথা, ওপরের পেটে ব্যথা, সার্ভাইক্যাল লিভ নোটসগুলো ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। ক্যানসার তখন জন্ডিস আকারে আসতে পারে। হাড়ে চলে গেলে হাড়ে ব্যথা হতে পারে। লাঙসে চলে গেলে কাশি এবং কাশির সঙ্গে রক্ত নির্গত হতে পারে।

ক্যানসার মানেই কি মৃত্যু, এমন প্রশ্নের জবাবে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘জরায়ুমুখের ক্যানসার স্টেজ ফোর পর্যন্ত চলে গেলেও আমরা চিকিৎসা করি নিরাময় করার লক্ষ্যে। রোগী স্টেজ ওয়ানে থাকলে এই ক্যানসার শতভাগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। যত স্টেজ বাড়বে, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা একটু একটু করে কমতে থাকবে। কিন্তু “ক্যানসার হ্যাজ নো আনসার” এই ধারণা পুরোপুরি ভুল। রোগটি শনাক্ত হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নেওয়া যাবে, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ততটাই বেড়ে যাবে।’

এরপর রুবামা করিমের কাছে উপস্থাপক জানতে চান, জরায়ুমুখের ক্যানসার কি ছোঁয়াচে? উত্তরে তিনি বলেন, জরায়ুমুখের ক্যানসার ছোঁয়াচে নয়। রোগীকে ছুলে, তাঁর গ্লাসে পানি খেলে, একই পাত্রে খাবার খেলে এই রোগ ছড়ায় না। কিন্তু সহবাসের মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। যাঁদের একাধিক যৌনসঙ্গী আছে, তাঁদের মধ্যে এই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি থাকে।

ঠিক কোন সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, এ বিষয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘এর দুটি ভাগ আছে। প্রথমটি হচ্ছে, কীভাবে রোগটিকে প্রতিরোধ করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া। দ্বিতীয় হচ্ছে, রোগটি যদি শনাক্ত হয়ে যায়, তখন। যেমন আমার এক রোগী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জরায়ুমুখের ক্যানসারের টিকা নিলে নাকি গর্ভধারণক্ষমতা কমে যায়। এর জবাব হলো, এই টিকার সঙ্গে গর্ভধারণের কোনো সম্পর্ক নেই। ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত যেকোনো সময় এই ভ্যাকসিন নেওয়া যায়। বয়সভেদে টিকার ডোজের তারতম্য হয়।’

জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, লক্ষণ দেখা দিলে সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সহবাসের পর রক্তক্ষরণ হলে, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে সেগুলো লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সাধারণত জরায়ুমুখে ঘা থেকে ক্যানসারের সূত্রপাত হয়। এ ধরনের কোনো ঘা হলেও সেটিকে লক্ষণ হিসেবে ধরে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ব্যথা বা রক্তপাত হলে সেটি ওষুধ খেয়ে বন্ধ করে ভুলে গেলে চলবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে।

এ পর্যায়ে উপস্থাপক রুবামা করিমকে প্রশ্ন করেন, জরায়ুমুখের ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য কত ধরনের স্ক্রিনিং হয়? স্ক্রিনিং এবং ডায়াগনোসিসের ভেতরে পার্থক্য কী?

উত্তরে রুবামা করিম বলেন, স্ক্রিনিং হলো এমন একটি টেস্ট, যেটি দ্বারা ক্যানসার একদম আর্লি স্টেজে শনাক্ত করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে প্রাদুর্ভাবের আগেও শনাক্ত করে ফেলা যায়। কিন্তু ক্যানসারের লক্ষণ যখন দেখা দিতে শুরু করবে, তখন যে টেস্টটা হবে, সেটি হচ্ছে ডায়াগনস্টিক টেস্ট।

বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, ডায়াগনোসিস, রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস ও ডা. রুবামা করিম
ছবি: প্রথম আলো

রুবামা করিম আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে একদম মাঠপর্যায়ে যে স্ক্রিনিংটা হয়, সেটা হচ্ছে “ভায়া টেস্ট”। এটি একদমই সহজ একটি পরীক্ষা। অ্যাসটিক অ্যাসিড নামের একটা সলিউশন জরায়ুমুখে দেওয়া হয়, সেটি যদি রং বদলে ফেলে, তাহলে ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। শিখিয়ে দিলে একদম মাঠপর্যায়ের কর্মীরাই তা করতে পারেন। এই টেস্ট সব জায়গায় করা যায়।’ এ ছাড়া প্যাপসমিয়ার, এইচপিভিসহ আরও কিছু টেস্টের নাম উল্লেখ করেন ডা. রুবামা করিম।

এইচপিভি ভ্যাকসিন কি শুধু নারীদেরই নেওয়া উচিত, নাকি পুরুষদেরও নেওয়া উচিত এবং জরায়ুমুখ-ক্যানসার রোধে এই ভ্যাকসিনের ভূমিকা কী?

উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের নিয়েই শুধু কাজ করা হয়, বহির্বিশ্বে ছেলেদেরও এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। যাতে পুরুষেরাও সব সময় ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারেন এবং এই ভ্যাকসিন শুধু জরায়ুমুখেরই নয়, আরও অনেক ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। তাই এই ভ্যাকসিনের গুরুত্ব অনেক বেশি।’

বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে রুবামা করিম বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশে ক্যানসারের কোনো চিকিৎসা নেই। এই ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। আর জরায়ুমুখের ক্যানসার সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য। আর্লি স্টেজে যদি শনাক্ত করা যায়, তাহলে এই ক্যানসার সারিয়ে তোলার সম্ভাবনা শতকরা ৯৯ ভাগ।’

রুবামা করিম আরও বলেন, ‘স্টেজ অনুযায়ী এই ক্যানসারের চিকিৎসা হয়। আর্লি স্টেজে আমরা সার্জারি করে থাকি। তখন জরায়ুমুখটা ফেলে দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে যান। পরের স্টেজে যখন ক্যানসারটা ছড়িয়ে যেতে শুরু করে, তখন ক্যানসারটা আর সার্জারির পর্যায়ে থাকে না। তখন আমরা “কনকারেন্ট কেমো রেডিয়েশনের” মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকি। সঙ্গে অন্যান্য চিকিৎসাও দেওয়া হয়। এই ক্যানসারের জন্য এটিই বিশ্বব্যাপী আদর্শ চিকিৎসা।’

অনুষ্ঠানের শেষপর্যায়ে উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, জরায়ুমুখের ক্যানসার নিয়ে সমাজে বেশ কিছু কুসংস্কার রয়েছে। এই কুসংস্কারগুলো কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ রয়েছে কি না?

জবাবে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘লক্ষণ দেখা দিলেও আমাদের দেশের অনেক নারী লজ্জার কারণে তা কাউকে বলেন না। অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। রোগকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পরিবারে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে এ ধরনের কুসংস্কারগুলো না থাকে।’