সরকারি তথ্য
তিন বছরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে দ্বিগুণ
অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এখন পানিতে ডুবে মৃত্যু।
বাড়ির পাশে খেলা করছিল তিন শিশু রুমান (৭), শারমিন (৫) ও মরিয়ম (৮)। এর মধ্যে রুমান ও শারমিন ভাইবোন। আর ওদের চাচাতো বোন মরিয়ম। বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বাদুরতলীর জিয়া কলোনিতে। ১২ মে দুপুরে তিন শিশুর মা–বাবা বাড়িতে ছিলেন না।
দাদি শেফালি বেগম ছিলেন বাড়িতে। দুপুরে এক প্রতিবেশী গরুকে পানি খাওয়ানোর জন্য ডোবা থেকে পানি তুলতে গেলে সেখানে এক শিশুকে ভাসমান দেখতে পান। তিনি ওই শিশুকে পানি থেকে তুলতে গেলে ডুবন্ত আরও দুই শিশুর মরদেহ দেখতে পান।
রুমান ও শারমিনের বাবা সোহেল ফকির অটোরিকশাচালক। তাঁর তিন সন্তান। দুই বছরের ছোট মেয়েকে নিয়ে ওই দিন তিনি ও তাঁর স্ত্রী চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তখনই ঘটে এই ভয়াবহ বিপর্যয়। সোহেল ফকির বুধবার মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘এমন ঘটনা যেন কারু জীবনে না হয়।’
ডুবে শিশুমৃত্যুর মতো এমন মর্মান্তিক ঘটনা বাড়ছে। সরকারি হিসাবেই দেখা গেছে, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এখন পানিতে ডুবে মৃত্যু। আর গত তিন বছরে এর হার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
আমরা গবেষণায় দেখেছি, প্রতিবছর পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এই মৃত্যুর বড় অংশের খবর পত্রিকায় আসে না।
ডুবে মৃত্যু রোধে সরকার গত বছরের (২০২২) ফেব্রুয়ারি মাসে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প নিয়েছে। তবে এক বছরের বেশি সময় পার হলেও এর অগ্রগতি নেই। আসছে বর্ষাকাল। এ সময়েই সাধারণত ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
গত মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে (২০২১) দেখা গেছে, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হয় পানিতে ডুবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) শিশুদের ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এগুলো হলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, সাঁতার শেখানো ও প্রাথমিক চিকিৎসা। ডব্লিউএইচওর তিন ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সিআইপিআরবির অভিজ্ঞতা থেকেই নেওয়া।
২০১৮ সালের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অনুযায়ী, দেশের পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর পঞ্চম বড় কারণ ছিল পানিতে ডুবে মৃত্যু। এই বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৩ ভাগ হতো পানিতে ডুবে। এই মৃত্যুর হার গ্রামে প্রায় ৪ শতাংশ আর শহরে ১ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
২০১৮ ও ২০২১—দুই সময়েই পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল নিউমোনিয়া।
মৃত্যু রোধ সম্ভব
গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। সংগঠনটির হিসাবে, ২০২০ থেকে ২০২২—এই তিন বছরে পানিতে ডুবে ৩ হাজার ২৮৫ জন মারা গেছে। এর ৮৭ শতাংশই শিশু।
সমষ্টির এ হিসাব শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করেন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান।
তিনি বলছিলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, প্রতিবছর পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এই মৃত্যুর বড় অংশের খবর পত্রিকায় আসে না।’ সিআইপিআরবি ২০০৫ সাল থেকে শিশুমৃত্যু রোধে কাজ করে আসছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর মে মাসে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ পাওয়া যায়। কিছুটা সময়ক্ষেপণ তো হয়েছেই। আমরা জুলাই থেকে জোরেশোরে কাজ শুরু করব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) শিশুদের ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এগুলো হলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, সাঁতার শেখানো ও প্রাথমিক চিকিৎসা। ডব্লিউএইচওর তিন ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সিআইপিআরবির অভিজ্ঞতা থেকেই নেওয়া।
সিআইপিআরবি দেশের ১০টি উপজেলায় ডুবে মৃত্যু রোধে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, সাঁতার শেখানো ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এসব কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয় আঁচল।
এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘সিআইপিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় আঁচল আছে, সেখানে ডুবে যাওয়ার ঘটনা ৮৬ শতাংশ কমে গেছে।’
সরকারি প্রকল্পে ধীরগতি
ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি ছিল অনেক আগে থেকেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ নামে প্রকল্প নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের আওতায় এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী দুই লাখ শিশুর জন্য আট হাজার সমাজভিত্তিক শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করার কথা। প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫ জন শিশুকে ভর্তি করা হবে। সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত শিশুরা ওই কেন্দ্রে থাকবে। এতে কর্মসংস্থান হবে ১৬ হাজার গ্রামীণ নারীর। ২৭১ কোটি ৮২ লাখ টাকার প্রকল্পটি গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদিত হয়।
প্রকল্প অনুযায়ী, ১৬ জেলায় এর কাজ চলবে। আর এসব পরিচালনা করবে স্থানীয় এনজিওগুলো। কিন্তু প্রকল্পের ১৫ মাস পরেও কেবল ১৬ জেলায় ১৬ কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন। এনজিওগুলোও কাজ শুরু করেনি। প্রকল্প পরিচালকও এখনো নিয়োগ হয়নি।
এ প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. তারিকুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর মে মাসে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ পাওয়া যায়। কিছুটা সময়ক্ষেপণ তো হয়েছেই। আমরা জুলাই থেকে জোরেশোরে কাজ শুরু করব। এখন প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য ১৮ মাস সময় পাওয়া যাবে।’