ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো ১০: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
হৃদয়বান বুদ্ধিমান মানুষেরা পৃথিবীটাকে সুন্দর করবে
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। আগামী বছর তাঁর ৯০ বছর পূর্তি আমরা উদ্যাপন করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক, এখন ইমেরিটাস অধ্যাপক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর খ্যাতি শিক্ষক হিসেবে প্রবাদে পরিণত। তিনি কোনো দিন কোনো ক্লাসে গরহাজির ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরী যেদিন মারা যান, কিংবদন্তি আছে যে সেদিনও তিনি ক্লাসে হাজির হন আর শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এই বলে যে ‘আজ আমি পড়াতে পারব না।’
কৈশোরেই হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন, তাতে বিখ্যাত মানুষদের লেখা প্রকাশিত হতো, তিনি নিজে হতে চেয়েছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক। কিন্তু অধ্যাপনা তাঁকে চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হতেই সাহায্য করল। অনেকগুলো মননশীল গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। বিলেতে পড়তে গিয়ে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হন, সারা জীবন ওই আদর্শ থেকে সরে যাননি। ২৬ অক্টোবর ২০২৫, জাতির অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভিডিও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় প্রথম আলো–ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো শীর্ষক সাক্ষাৎকারগুচ্ছের অংশ হিসেবে।
তাঁর নিজের মুখে বেড়ে ওঠা আর কর্মময় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শোনা একটা সৌভাগ্যের বিষয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম নানাবাড়িতে, বিক্রমপুরে। শৈশবের আড়িয়ল বিলকে মনে পড়ে তাঁর। এই বিলকে মনে হতো সাগরের মতো বিশাল।
ময়মনসিংহে বাবার চাকরি হলো, সেখানে কিছুদিন থেকে এসে নামলেন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে। তাঁর মেজ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, সেই কিশোর ঢাকায় পা রেখে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। কলকাতার তুলনায় সবকিছু ছোট, অপরিচ্ছন্ন, ঘোড়ার গন্ধ। ভাড়া নেওয়া যাবে, এমন বাড়ি নেই বললেই চলে।
গ্রামের পাঠশালায় হাতেখড়ি, তারপর পিতার কর্মসূত্রে গিয়ে ভর্তি হন রাজশাহীতে, লোকনাথ স্কুলে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর বাবার প্রমোশন হলো, পোস্টিং কলকাতায়। তাঁরা কলকাতা গেলেন। ১৯৪৭-এর পর ফিরে এলেন। এসে উঠলেন বিক্রমপুর, নানাবাড়ি পদ্মা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখলেন স্টিমার আসছে, তাতে পাকিস্তানের পতাকা আর ছোট ছোট তিনকোনা নিশান, তীরে দাঁড়িয়ে তাঁরা স্লোগান দিলেন আর স্টিমার থেকে স্লোগান দিল যাত্রীরা। তারপর নেমে এল নীরবতা। তিনি মনে করার চেষ্টা করেন, যাঁরা কলকাতায় বেসরকারি চাকরি করতেন, তাঁরা আর চাকরি পাবেন না। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের সামনে অনিশ্চয়তার আঁধার। ময়মনসিংহে বাবার চাকরি হলো, সেখানে কিছুদিন থেকে এসে নামলেন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে। তাঁর মেজ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, সেই কিশোর ঢাকায় পা রেখে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। কলকাতার তুলনায় সবকিছু ছোট, অপরিচ্ছন্ন, ঘোড়ার গন্ধ। ভাড়া নেওয়া যাবে, এমন বাড়ি নেই বললেই চলে।
সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে ভর্তি হলেন। বেগমবাজারে আত্মীয়বাড়ি থেকে তাঁরা এসে উঠলেন আজিমপুরে নবনির্মিত কলোনিতে। সেখানেই তাঁদের সামনে সুযোগ এল নানা ধরনের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করার। ৫০০ পরিবার, সবাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবার, ছেলেমেয়েরা মিলে হাতে লেখা পত্রিকা, দেয়ালপত্রিকা বের করতে শুরু করেন। বাঁশে টাঙানো হয়েছিল বলে একটা পত্রিকাকে বলতেন তাঁরা বাঁশ-পত্রিকা।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। নিজের নাম খুঁজেছেন প্রথম শ্রেণিতে, নেই; দ্বিতীয় শ্রেণিতে, নেই। মন খারাপ করে ফিরছেন, তখন মেজ ভাই হাজির। বললেন, চল, আবার দেখি। ভাই নাম খুঁজলেন প্রথম পাতা থেকে। সেটা মেধাতালিকা।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়। ১৬ বছরের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেন্ট গ্রেগরী কলেজে পড়েন। আজিমপুর থেকে চলে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, এখন যেখানে খেলার মাঠ। সভায় যোগ দিলেন। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করল। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আক্রান্ত চোখ ধুয়েছিলেন পুকুরের পানিতে। তারপর বাড়ি চলে আসেন। পরের দিন আবার মিছিল। পুরান ঢাকার উর্দুভাষীরা মিছিলে যোগ দিল, যখন শুনল গুলিতে ছাত্র মারা গেছে।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। নিজের নাম খুঁজেছেন প্রথম শ্রেণিতে, নেই; দ্বিতীয় শ্রেণিতে, নেই। মন খারাপ করে ফিরছেন, তখন মেজ ভাই হাজির। বললেন, চল, আবার দেখি। ভাই নাম খুঁজলেন প্রথম পাতা থেকে। সেটা মেধাতালিকা। তিনি নবম হয়েছেন। তাঁর সহপাঠী গিয়াসউদ্দীন, যিনি পরে একাত্তরে শহীদ হলেন, তিনি হয়েছিলেন দশম। তখনই সবাই সেন্ট গ্রেগরী কলেজের নাম জানতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।
ইংরেজি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বের হন ১৯৫৭ সালে। হরগঙ্গা কলেজে পড়ান, তারপর জগন্নাথ কলেজে। মুনীর চৌধুরী স্যারও কিছুদিন পড়িয়েছেন জগন্নাথে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ইংরেজির প্রভাষক, সিএসপিতে যোগ দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ খালি হয়। তাঁকে ফোন করে ডেকে নেন ইংরেজির অধ্যাপক টার্নার সাহেব। তিনি সেই যে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ বছর বয়সে যোগ দিলেন, আজ ৮৯ বছর বয়সেও তিনি সেখানকারই অধ্যাপক। যদিও বাবা চেয়েছিলেন তিনি সিএসপি হন।
আমরা সেই আশাতেই থাকি, হৃদয়বান আর বুদ্ধিমান মানুষেরা পৃথিবীটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলবে একদিন।
উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন বিলেতে। প্রথমে লিডসে, তারপর লেস্টারে। পিএইচডি করেছেন জোসেফ কনরাড, ই এম ফস্টার আর ডি এইচ লরেন্সকে নিয়ে। এই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকদের সব উপন্যাস তাঁকে পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, পড়তে কষ্ট হয়েছে, কিন্তু দুনিয়ার দরজা খুলে গেছে। এইখানেই প্রশ্ন, এরপর তিনি নিজে কেন উপন্যাসকেই তাঁর ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন না। তিনি মনে করেন, অধ্যাপনার কারণে তাঁর ফিকশন লেখা হয়নি। কারণ, অধ্যাপকের কাজ বিশ্লেষণ করা আর কথাসাহিত্যিকের কাজ সংশ্লেষণ করা। দুটো বিপরীত কাজ।
১৯৭১ সালে তাঁর নাম হন্তারকদের তালিকায় ছিল। ২৫ মার্চ জগন্নাথ হলের কাছে ছিলেন। অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে জগন্নাথ হলের সেই বিভীষিকাময় রাত, ছাত্রদের ধরে এনে গর্ত খুঁড়িয়ে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হলো, আবার সেখানেই তাদের সার করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হলো। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার ছাড়লেন। ফলে তালিকার অন্য সবাই একাত্তরে শহীদ হলেও তিনি এখনো আছেন আমাদের মধ্যে। স্বাধীনতার পর সমষ্টির স্বপ্নকে ব্যক্তিগত স্বপ্নের আঘাতে ধ্বস্ত হতে দেখলেন।
১৯৮৯ সালে স্ত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরী মারা যান। তিনি বিচিত্রা পত্রিকায় লিখলেন একটা অসাধারণ প্রবন্ধ—বন্ধুর মুখচ্ছবি। এরপর দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকাতেই আছেন, ৩৬ বছর। মেয়েরা আছে বলে নিজেকে একা ভাবেন না।
এখনো তিনি আশা আর স্বপ্ন ধারণ করে রেখেছেন। পুঁজিবাদী এই অবিচার–অন্যায়–বৈষম্যের অবসান ঘটবে। তা ঘটাবে সেই মানুষেরা, যারা একই সঙ্গে হৃদয়বান আর বুদ্ধিমান।
আমরা সেই আশাতেই থাকি, হৃদয়বান আর বুদ্ধিমান মানুষেরা পৃথিবীটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলবে একদিন।