অধ্যাপকের সৌজন্যবোধ

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

সময়টি ছিল ২০২২ সালের মে মাস। আমি তখন ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটিতে দুগ্ধ খাতে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে ডিপ্লোমা করছিলাম। এক সপ্তাহান্তে দুই দিনের ছুটি কাটাতে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে হোহেনহেম ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিরত ছোট ভাই বাশারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এক শুক্রবারের পড়ন্ত বিকেলে ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষে কোপেনহেগেন থেকে বাসযোগে স্টুটগার্ট শহরের উদ্দেশে রওনা হলাম। ১৮ ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পরের দিন শনিবার হোহেনহেম ইউনিভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে বাশারদের রুমে পৌঁছালাম।

প্রথম দিন স্টুটগার্ট ও কাছাকাছি এসলিংজেন শহরের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে পরের দিন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে রাইনফলস জলপ্রপাত দেখার জন্য ইন্টারসিটি ট্রেনে করে রওনা দিলাম। ঠিক রাইনফলস ঝরনার পাশের শাফহাউসেন স্টেশনেই নেমে পড়লাম। স্টেশন থেকে নেমে কয়েক কদম হেঁটে লিফটে চড়ে রাইনফলসের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। এই রাইনফলস হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের সর্বাধিক জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম। রাইন নদী হচ্ছে ইউরোপের অন্যতম দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা সুইস আল্পস পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস হয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে উত্তর সাগরে। এই রাইন নদীর প্রাকৃতিক ভাঁজে সৃষ্টি হয়েছে অপার সৌন্দর্যের আধার এই রাইনফলস জলপ্রপাত। ইউরোপের নায়াগ্রা বলে খ্যাত নীল জলের এই জলপ্রপাত সাড়ে ৪০০ ফুট চওড়া এবং ৭৫ ফুট উঁচু। সারা দিন রাইনফলস জলপ্রপাত দেখার পর বিকেল নাগাদ সুইজারল্যান্ডের ঘন সবুজে ঢাকা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রেলপথে ছুটে চলা ট্রেন ধরে স্টুটগার্ড শহরে ফিরে আসি।

ইচ্ছা ছিল রাতের প্লেনে অথবা ট্রেনে করে কোপেনহেগেনে ফিরে পরের দিনের সকালের ক্লাস ধরব। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে প্লেন ও ট্রেন—কোনোটারই টিকিট কাটতে না পেরে ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করলাম। কোপেনহেগেনে ফেরাটা অনিশ্চিত ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলাম; কেননা পরের দিন সকাল আটটায় আমার ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস ছিল। আমি জার্মানিতে আসার সময় আমার প্রফেসরকে কোনো কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি। রাতে বাশারদের রুমে ফিরে ভাবছিলাম, কীভাবে বিষয়টি আমার প্রফেসরকে জানাব। অনেক ভেবেচিন্তে প্রফেসরকে আমি অসুস্থ বলে একটি ই-মেইল করার চিন্তা করলাম, যা আমাদের দেশে হামেশাই আমরা করে থাকি। তারপর কী ভেবে জার্মানিতে থাকা ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এ ধরনের পরিস্থিতিতে তোমরা সাধারণত কী করো?

ছোট ভাই আমার চিন্তাভাবনা শুনে হেসে বলল, ভাই টিকিটের মূল্য অতিরিক্ত হওয়ায় আপনি তা ক্রয় করতে পারেননি, সেই প্রকৃত বিষয়টি উল্লেখ করে আপনার প্রফেসরকে ই-মেইল করে বলেন যে এই কারণে আপনি আগামীকালের ক্লাসে উপস্থিত হতে পারবেন না।

ছোট ভাইটি আরও বলল, আপনার এই ই-মেইল পাওয়ার পর আপনার প্রফেসর আপনাকে এ বিষয়ে চিন্তিত না হয়ে ভালোভাবে কোপেনহেগেনে ফেরার বিষয়ে উইশ করে আপনার ই-মেইলের উত্তর দেবেন এবং পরদিন ক্লাসে গেলে প্রথমেই আপনার খোঁজখবর নেবেন।

ছোট ভাইয়ের কথামতো আমি প্রকৃত কারণ উল্লেখ করে আমার প্রফেসরকে ই-মেইল করলাম। সত্যি আমাকে অবাক করে দিয়ে ই-মেইল করার ১০ মিনিটের মধ্যে প্রফেসরের উত্তর পেলাম। তিনি যা লিখলেন তার বাংলা এ রকম—

প্রিয় মোহাম্মদ,

ঠিক আছে। মঙ্গলবার দেখা হবে।

শুভকামনা।

হ্যানি,

অধ্যাপক,

পশুচিকিৎসা ও প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক।

প্রফেসরের এই ই-মেইল পেয়ে সত্যি আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরও অবাক হলাম, যখন পরের দিন ক্লাসে উপস্থিত হলাম। সত্যি সত্যি তিনি আমাকে আমার সুস্থতা ও ফেরার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

ছোট একটি ঘটনা, কিন্তু প্রফেসরের এই সৌজন্যবোধ দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এখনো ওই প্রফেসরের কথা মনে পড়ে আমার।