শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ছেলে হত্যার বিচারের জন্য লড়ব: দিয়াজের মা

হাসপাতালে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী। বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে
ছবি: গাজী ফিরোজ

পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন নাকচ করে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বলেছেন, তাঁর ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যা রহস্য উদ্‌ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়বেন না। জাহেদা আমিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতক্ষণ নিশ্বাস থাকবে, ততক্ষণ ছেলে হত্যার বিচারের জন্য লড়ে যাব।’

তিন দিন ধরে চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন জাহেদা আমিন। তাঁকে না জানিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে দিয়াজ হত্যা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ খবর শুনে হাসপাতালের শয্যায় ছটফট করতে থাকেন জাহেদা আমিন চৌধুরী। রাতে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে মশারির ভেতর শুয়ে আছেন তিনি। গায়ে জ্বর। কিছুক্ষণ পরপর কাশি দিচ্ছেন। ডান হাতে স্যালাইন লাগানো। আর তাঁর চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু।

জাহেদা আমিন অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলে হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। প্রভাবিত হয়ে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। নিয়ম থাকলেও তাঁকে না জানিয়ে প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন হাসপাতালে না থাকলে কেন তাঁর ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, সে বিষয়ে সিআইডি কার্যালয়ে গিয়ে কৈফিয়ৎ চাইতেন।

পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ছেলেকে উদ্দেশ করে দিয়াজের মা বলতে থাকেন, ‘এত দিন লড়াই করেও পুত (দিয়াজ) তোর জন্য কিছু করতে পারিনি। তুই কি আমাদের ক্ষমা করবি?’ এরপর বেশ কিছুক্ষণ কান্না করতে থাকেন তিনি। আবার বলতে থাকেন, দিয়াজ হত্যার শেষ দেখে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন।
জাহেদা আমিন অভিযোগ করে বলেন, ঘটনাস্থল তাঁদের বাসার নিচের এক দোকানদারকে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা সাক্ষী করেনি। অথচ ওই দোকানদার অনেক কিছু জানেন। সিআইডি এক নারীর জবানবন্দি নিয়েছে, তিনি সব কিছু মিথ্যা বলেছেন।

আরও পড়ুন
দিয়াজ ইরফান চৌধুরী
ফাইল ছবি

২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় নিজের বাসা থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন বাসায় দিয়াজ ছাড়া পরিবারের আর কেউ ছিলেন না। এর ২২ দিন আগে দিয়াজসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের চার নেতার বাসায় সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালায়। ৯৫ কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতির অনুসারী নেতা-কর্মীরা ওই হামলা চালান বলে অভিযোগ ওঠে। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যাওয়ার আগে দিয়াজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

লাশ উদ্ধারের তিন দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর টিপুসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন জাহেদা আমিন চৌধুরী। পরে এই মামলায় ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার ঠিকাদার জি কে শামীমকেও আসামি করা হয়।

আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আলমগীর টিপু ও জি কে শামীমসহ সব আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সিআইডি। এতে বলা হয়েছে, দিয়াজকে খুন করা হয়নি।

কীসের ভিত্তিতে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হলো, সে প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুস সালাম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তথ্যগত ভুল উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু জানাতে চাননি তিনি।

দিয়াজের ময়নাতদন্ত নিয়েও জটিলতা দেখা দেয়। ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্তে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন চিকিৎসকেরা। পরিবার ও ছাত্রলীগের একাংশ (দিয়াজের অনুসারী) তা প্রত্যাখ্যান করলে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজকে শ্বাস রোধ করে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারী গঠিত বিষয়ে দিয়াজ আত্মহত্যা করেন। তাঁকে কেউ খুন করেনি। ঘটনার দিন দিয়াজ তাঁর পরিচিত এক নারীকে বাসায় আসতে বলেন। না আসায় ক্ষোভে নিজে আত্মহত্যা করেন। এ জন্য তথ্যগত ভুল উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তবে দিয়াজের মা দাবি করেন, তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ের আগে ওই নারী কেন বাসায় আসবে। সব পুলিশের সাজানো নাটক। তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনা সম্পর্কে জানে অনেককে সাক্ষী না করে ওই নারীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

দিয়াজের লাশ উদ্ধারের পর থেকেই জাহেদা আমিন এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে অনশনসহ নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী সমিতির বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে লুটিয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উপলক্ষে বের করা স্যুভেনিরে দিয়াজ হত্যা মামলার প্রধান আসামি আলমগীর টিপুর ছবি-সংবলিত শুভেচ্ছা বাণী দেখে মেনে নিতে পারেননি তিনি। জাহেদা আমিনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী। পরে মাঠে লুটিয়ে পড়ে স্রষ্টার কাছে বিচার চান তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তার আগের বছর ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।