ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে বাড়ছে পানির দূষণ

ইলিশ মাছ
ফাইল ছবি

পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পানির গুণগত মানের অবনতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পরিমাণ। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে ইলিশ উৎপাদনের ওপর একসময় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যেই নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ, দূষণ।

ইলিশের যেসব বিচরণক্ষেত্র আছে, সেসব স্থানে পানির মান দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসছে সরকারের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুর। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা প্রতিবছর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও-ডিসলভ অক্সিজেন), পিএইচ, পানি ও বায়ুর তাপ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ইত্যাদি দেখেন।

বর্ষার এই সময় ইলিশ মূলত দুটি কারণে সাগর ছেড়ে নদীর দিকে আসতে শুরু করে। একটি কারণ হলো খাবার সংগ্রহ, দ্বিতীয়টি প্রজনন। ইলিশের এই আগমনে নদীর পানির গুণাগুণ বড় নিয়ামক ভূমিকা রাখে। পানির মান ভালো হলে ইলিশের এই বিহার নির্বিঘ্ন হয়, জেলের জালেও আটকা পড়ে বেশি।  

পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। সাধারণত মেঘনা নদীর মুন্সিগঞ্জের ষাটনল, চাঁদপুরের আনন্দবাজার সফর মালি, মতলবের লঞ্চঘাট, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মিলনস্থলের এলাকার পানির মান দেখা হয়। আর পদ্মার শরীয়তপুরের তারাবুনিয়া, ভোমকারা, কাছিকাটা, মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া, পাবনার ঈশ্বরদী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার মান দেখা হয়।

ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পানির মান কেমন

পানির মান বিচারে অন্যতম নিয়ামক হলো পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিও। যদি ডিওর পরিমাণ প্রতি লিটারে পাঁচ মিলিগ্রামের কম হয়, তবে তা জলজ পরিবেশের জন্য কম উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। দেখা গেছে, পদ্মায় গত পাঁচ বছরে ডিওর মান কমেছে। ২০১৮ সালে পানিতে এ নদীতে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৭০। এর পর থেকে কমছে প্রায় প্রতিবছর। ২০২২ সালে ডিওর মান ছিল ৫ দশমিক ৪১।

মেঘনায় ২০১৮ সালে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৪০। এটি ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাসায়নিক যৌগ হলো অ্যামোনিয়া। যে পানির মান ভালো, সেখানে এর শূন্য উপস্থিতি থাকতে হবে। পদ্মায় ২০১৮ সাড়ে পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি ছিল শূন্য দশমিক ৪ ভাগ। গত বছরও ছিল তা-ই।
মেঘনায় পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। এটি গত বছর হয়েছে শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ।

গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জলজ প্রতিবেশে দূষণ যেকোনো মাছের জন্যই ক্ষতিকর। তবে ইলিশ অনেক বেশি সংবেদনশীল মাছ। দূষণের ফলে প্রতিবেশের সামান্য পরিবর্তন ইলিশ নিতে পারে না। ইলিশ তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। পানিতে অ্যামোনিয়ার বৃদ্ধি ইলিশের খাবারের চাহিদায় পরিবর্তন করতে পারে।  

অ্যাসিড ও ক্ষারের পরিমাপক হলো পিএইচ। জলজ প্রাণীর সহনীয় পরিবেশের ক্ষেত্রে পিএইচ থাকতে হবে সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮-এর মধ্যে। ৭-এর নিচে নয়।
পদ্মা নদীতে পিএইচের গড় উপস্থিতি ছিল ৮। গত বছর এর পরিমাণ কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭।

মেঘনায় ২০১৮ সালে পিএইচের উপস্থিতি ছিল ৮ দশমিক ১৩।
২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে পদ্মায় পানির তাপমাত্রা প্রায় ২৫ থেকে বেড়ে ৩০ ডিগ্রি হয়েছে। এ সময় অবশ্য মেঘনায় পানির তাপ ২৭ দশমিক ৪০ থেকে কমে প্রায় ২৭ হয়েছে।

পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা মাছের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে বলে মন্তব্য করেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম। তিনি শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা ও মেঘনায় ইলিশের বিচরণক্ষেত্রের ওপরের অংশে পানির দূষণ অপেক্ষাকৃত বেশি। কিন্তু নিচের দিকে কম। মেঘনার পানির দূষণ পদ্মার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। মেঘনার সঙ্গে যুক্ত আছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ। এসব নদীর পাড়ে অনেক কারখানা আছে। সেই তুলনায় পদ্মাপাড়ে কারখানার সংখ্যা কম।  

কমছে ইলিশের খাদ্যের পরিমাণ

মো. আশরাফুল আলম

ইলিশ বা যেকোনো মাছ জলজ পরিবেশের খাবারের ওপরই নির্ভর করে। মো. আশরাফুল আলম বলেছেন, ইলিশের খাদ্যের মধ্যে ৪২ শতাংশই শৈবাল। এরপরই আছে বালু বা ধ্বংসাবশেষ, ৩৬ শতাংশ। বাকি খাবারের মধ্যে আছে ডায়াটম, রটিফার, প্রোটোজায়া। ইলিশ মাছের খাদ্যতালিকায় মোট ২৭ প্রজাতির উদ্ভিদ কণা এবং ১২ প্রজাতির প্রাণী কণা রয়েছে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৬ সালের তুলনায় গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, ইলিশের খাবারের পরিমাণ ৬ শতাংশ কমে গেছে।
নদীতে ইলিশের উৎপাদনের হার কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পদ্মা ও মেঘনায় ইলিশের উৎপাদনের হার আগের বছরের তুলনায় ৫৬ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। পরের বছর এই বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় দুই শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে আড়াই শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৯-২০ সালে তা কমে হয় শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, পদ্মা ও মেঘনা—দুই নদীর ওপরের দিকে দূষণ বেশি। আবার দুই নদীর ওপরের দিকে উৎপাদনও কমেছে। ২০১৭-১৮ সালে পদ্মার ওপরের দিকে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন। এটা ২০২০ সালে কমে যায় ৬০৪ মেট্রিক টনে। মেঘনায় ২০১৭-১৮ সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৭ মেট্রিক টন। দুই বছর পর তা সামান্য বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১১১ মেট্রিক টন।

দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নের কারণে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট লোকজন। দেশে ২০১৮-১৯ সালে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন। ২০২০-২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন। ইলিশের এই উৎপাদন বৃদ্ধিতে পানির দূষণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পানির দূষণ ইলিশের প্রজনন হার, ইলিশের আকার এবং সার্বিকভাবে এর উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শিল্পসহ নানা ধরনের বর্জ্য ইলিশের জলজ প্রতিবেশ নষ্ট করছে। এই বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার।