শিউলি বেগম, খাদিজা বা জাকিয়া সুলতানারা এসেছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় গৃহকর্মী সম্মেলনে অংশ নিতে ছুটি নিয়েছেন কাজের জায়গা থেকে। একে একে মঞ্চে এসে নিজেদের বঞ্চনা ও ক্ষোভের কথা বললেন এই গৃহকর্মীরা। মঞ্চে তখন উপস্থিত পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মুজিবুল হকসহ আরও অনেকে।
শ্রমের মূল্য নেই, নির্যাতনের বিচার নেই, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে আয়ের নিশ্চয়তা না থাকার বিষয়গুলো বলতে বলতে ক্ষোভ জানালেন গৃহকর্মীরা। খাদিজা নামের একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আমরা কি মানুষ না?’ এরপরই আরেকজন বলেন, ‘আমরা আপনাদের ঘর মুছি, রান্না করি, তাই স্বামী-স্ত্রী বেশি টাকার চাকরি করতে বের হয়ে যান নিশ্চিন্তে।’ তাঁদের ক্ষোভের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী আবুল হোসাইন বলেন, ‘শ্রম দিয়ে খাই, মানবিক অধিকার চাই।’
গৃহকর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা এবং বাংলাদেশ শ্রম আইনে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির দাবি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় গৃহকর্মী সম্মেলন ২০২২। সম্মেলনের স্লোগান ‘গৃহকর্মীদের অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার’। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান, তবে তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনি সহায়তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গৃহকর্মীদের শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর আইন প্রণয়ন ছাড়া আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগে গৃহশ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন সম্মেলনের বিশেষ অতিথি মুজিবুল হক।
এর আগে আলোচনায় উঠে আসে রাজধানীর গৃহশ্রমিকদের বাসস্থান সমস্যার চিত্র। এর সমাধানে ভূমিহীন গৃহশ্রমিকদের তালিকা করে শ্রম অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দেওয়ার কথা বলেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। এ প্রক্রিয়ায় ভূমিহীন হিসেবে গৃহকর্মীদেরও সরকারি ঘর পাওয়ার সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন গৃহশ্রমিকেরা। জন্মসনদ তৈরি করতেই তাঁদের যে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সে অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন মিরপুরের টবলক বস্তির বাসিন্দা গৃহশ্রমিক সোনিয়া।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিকেই ভিডিও বার্তার মাধ্যমে গৃহশ্রমিকদের শুভেচ্ছা জানান অভিনেতা ও সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর। গৃহশ্রমিকের কাজকে পেশা হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়ে তাঁদের প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলেন তিনি। অক্সফামের সিকিউরিং রাইটস প্রজেক্ট সমন্বয়কারী গীতা রানী অধিকারী জানান, সারা দেশে ২০ লাখের বেশি গৃহকর্মী আছেন, যাঁদের ৯০ শতাংশই নারী। এর একটি বড় অংশ শিশু।
গৃহকর্মীদের আয় জিডিপিতে প্রতিফলিত হয় না উল্লেখ করে তাঁদের নিয়ে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন গীতা রানী। গৃহশ্রমিকদের জন্য নীতি প্রণয়ন করা হলেও তার পুরো বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করেন শ্রমসচিব মো. এহছানে এলাহী। এ সময় তিনি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মনিটরিং সেলের সভা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আহ্বান করে সম্ভাব্য সব উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
গণসাক্ষরতা অভিযানের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে সহযোগিতা করেছে সুনীতি প্রকল্পের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অক্সফাম ইন বাংলাদেশ। সহযোগী হিসেবে আরও ছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হ্যালো টাস্ক, কর্মজীবী নারী, নারী মৈত্রী, রেড অরেঞ্জ ও ইউসেপ বাংলাদেশ। সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রায় ৭০০ গৃহশ্রমিক। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন এ আয়োজনে।
জাতীয় গৃহকর্মী সম্মেলন ২০২২-এর সভাপতিত্ব করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। অতিথিদের বক্তব্যের মাঝে মাঝে গৃহকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন তিনি। গৃহকর্মীরা অনেকের জীবন সহজ করে দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সাড়ে তিন ঘণ্টার সম্মেলন শেষে কয়েক শ গৃহকর্মী ভবিষ্যতের আশ্বাস নিয়ে বের হয়ে আসেন। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন চত্বরে দাঁড়িয়ে তখন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেছেন তাঁরা। কেউ দল বেঁধে ছবি তুললেন। কেউ যত্ন করে গুছিয়ে নিলেন উপহার পাওয়া ব্যাগ আর সম্মানীর টাকা।