২১ আগস্ট কোথায় ছিলাম...

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাফাইল ছবি

একসময় একটা কথা খুব শুনতাম। প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মাত্রই নাকি পরিষ্কার মনে করতে পারেন, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় তিনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন, কীভাবে খবরটা পেয়েছিলেন। ৫৯ বছর আগের কথা, সেই আমেরিকানদের সংখ্যাটা নিশ্চয়ই এখন অনেক কমে এসেছে। এখন হয়তো জন এফ কেনেডির গুলিবিদ্ধ হওয়ার জায়গা নিয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা। নিজের কথা বলি। সেদিন আমি ছিলাম কলকাতায়।

নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম ট্যুর কাভার করতে যাব। ঢাকায় নিউজিল্যান্ডের কোনো দূতাবাস নেই বলে ভিসা নিতে দিল্লি যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে কলকাতায় যাত্রাবিরতি। বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি। যোধপুর পার্কে যে মাসির বাসায় ছিলাম, যে মাসি এই কালো ছেলের নাম শুভ্র রেখে ‘কালার ব্লাইন্ড’ অপবাদ গায়ে মেখেছেন, সেই ছোট্ট মাসিই সন্ধ্যার দিকে  আমাকে ডেকে তুলে বলেন, ‘দেখে যা, আমেরিকায় কী কাণ্ড হয়েছে!’ টেলিভিশনে তখন অনবরত দেখিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে প্লেন ঢুকে যাওয়া অভাবনীয় সেই দৃশ্য। দেখেও যা বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না।

জন এফ কেনেডির গুলি খাওয়া বা বিশ্বকে বদলে দেওয়া নাইন-ইলেভেনের মতো বাঙালিরও এমন ‘আমি তখন কোথায় ছিলাম’ মুহূর্ত আছে। একাধিকই আছে। সবার ওপরে নিশ্চয়ই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হয়তো এরপরই।

২১ আগস্ট সকালে এমপিসিতে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই পেয়েছিলাম গ্রেনেড হামলার খবরটা। এর অব্যবহিত পরের অনুভূতিটা পরিষ্কার মনে করতে পারি। মাথা শূন্য, হাত-পা রীতিমতো অসাড়।

১৫ আগস্টের স্মৃতি একেবারেই আবছা। ১৯৭৫ সালে ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবার চাকরিসূত্রে আমাদের বাস তখন টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার সহবতপুর নামে ছোট্ট এক ইউনিয়ন-শহরে। ‘শহর’ কথাটা একেবারেই বাড়াবাড়ি, নাগরপুরকেই তখন ঠিক শহর বলা যায় না। ইউনিয়ন-শহরের বদলে সহবতপুরকে বরং বলা উচিত ‘ইউনিয়ন-গ্রাম’!

১৫ আগস্টের ওই নারকীয় রাতের কথা জেনেছিলাম পরদিন সকালে। যত দূর মনে পড়ে, তা জানিয়েছিলেন আমার বাবু (বাবাকে আমরা তিন ভাইবোন ‘বাবু’ই ডাকতাম)। বাকি সব আবছা হলেও সেই মুহূর্তটা এখনো পরিষ্কার মনে করতে পারি। সহবতপুরে আমাদের টিনের ঘরের ভিটে ছিল মাটির। মোটামুটি প্রশস্ত বারান্দাটাও তা-ই। খবরটা শোনার সময় আমি সেখানে বসে। বঙ্গবন্ধুকে কারা যেন মেরে ফেলেছে। ভয়াবহতাটা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম বলে মনে হয় না। তখন যে আমি একেবারেই পিচ্চি! আমাদের সময় তো আর প্লে-নার্সারি-কেজির সিঁড়ি বেয়ে ক্লাস ওয়ানে উঠতে হতো না, সরাসরিই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি। সেই ভর্তিও হয়ে গেছি চার বছর বয়সেই। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাই কত হবে আমার বয়স? আট হয়েছে, বা হতে যাচ্ছে। আগে-পরের কোনো কিছু তাই সেভাবে মনে পড়ে না।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সেই সমস্যা নেই। খবরটা পেয়েছিলাম এথেন্স অলিম্পিকের এমপিসি মানে মেইন প্রেস সেন্টারে বসে। জীবনের প্রথম অলিম্পিক কাভার করতে গেছি। এমনই রোমাঞ্চিত যে ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে ছুটে খেলা দেখা আর লেখার পেছনে প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘণ্টা ব্যয় করেও দেহমনে কোনো ক্লান্তি নেই। এথেন্স অলিম্পিকে আমি যে মিডিয়া ভিলেজে উঠেছিলাম, শহর থেকে তা অনেক দূরে। সাগরের পাশে অপূর্ব একটা জায়গা। সেই মিডিয়া ভিলেজ বহুতল তিন-চারটি ভবন নিয়ে নয়, তাতে তিন-চারতলা অসংখ্য ভবন। তা এমন বিশাল জায়গাজুড়ে যে সেখান থেকে এমপিসিতে যাওয়ার বাস ডিপোতে যেতেই ট্রেন লাগে! না হয় সেই ট্রেন একটু উচ্চতর খেলনা ট্রেনজাতীয় কিছু, তারপরও ট্রেনই তো! সকালে সেখান থেকে বেরোই, ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

২১ আগস্ট সকালে এমপিসিতে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই পেয়েছিলাম গ্রেনেড হামলার খবরটা। এর অব্যবহিত পরের অনুভূতিটা পরিষ্কার মনে করতে পারি। মাথা শূন্য, হাত-পা রীতিমতো অসাড়। সময় পার্থক্যের কারণে সেই অলিম্পিকে দিনের ইভেন্ট দিনে লেখার কোনো সুযোগ ছিল না (যে চারটি অলিম্পিক কাভার করেছি, এর মধ্যে একই বেইজিং ছাড়া বাকি তিনটিতেই একই ঘটনা)। শিরোপা নির্ধারণী সবকিছুই তো হতো রাতে, বাংলাদেশ যখন মধ্যরাত পেরিয়ে ভোরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। এথেন্স থেকে লেখা পাঠানোর শেষ সময় ছিল স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটা। আগের রাতের ইভেন্ট বা আলোচিত কোনো ঘটনা নিয়েই তাই লিখতে হতো। সকালে উঠে এমপিসিতে গিয়ে লিখে-টিখে তা পাঠিয়ে পরদিনের লেখার রসদ জোগাড় করতে বেরোনো—এটাই ছিল রুটিন।

সেদিনও মিডিয়া ভিলেজ থেকে এমপিসি পর্যন্ত এক ঘণ্টা/সোয়া ঘণ্টার ট্রেন/বাস যাত্রাপথে আজ কী লিখব, মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছি। কিন্তু ওই গ্রেনেড হামলার ব্যাপকতা ও আসল উদ্দেশ্য বোঝার পর মাথা থেকে সেসব বেমালুম উবে গেছে। খবরও পাচ্ছিলাম নানা রকম। যেটির উৎস মূলত বাংলাদেশের অন্য সব সাংবাদিক। বাংলাদেশ তো তখন আর এমন ব্যাঙের ছাতার মতো অনলাইনে সয়লাব নয়। অফিসে ফোন করা ছাড়া আসল খবর পাওয়ার উপায় নেই। সেই টেলিফোন আবার বহুমূল্য, লাইন পেতেও বিস্তর ঝামেলা। তারপরও যা খবর পেলাম, তা আর যা-ই হোক, খেলার মতো ‘তুচ্ছ’ বিষয় নিয়ে লেখায় মন বসাতে মোটেই সহায়ক নয়। তারপরও পেশাদারত্বের দায় মেনে এবং নিজেকে বারবার তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনটি লেখা লিখতে সক্ষম হলাম। লিখতে আমার এমনিতেই খুব কষ্ট হয়। তবে সেদিনের কষ্টের কোনো তুলনা নেই।

আরও পড়ুন

এর সোয়া তিন বছর আগে ভয়াবহতা এবং নারকীয়তার দিক থেকে ২১ আগস্টের কাছাকাছি যে দিনটি কালো আঁধার হয়ে বাংলাদেশে নেমে এসেছিল, কপালগুণে সেদিন এই কষ্ট থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। ২০০১ সালের পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বোমা হামলার সময়ও আমি দেশের বাইরে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রথম ট্যুর কাভার করতে জিম্বাবুয়েতে। বুলাওয়ের হলিডে ইন হোটেলে ঘুম ভাঙার পর টেলিভিশন চালাতেই দেখি, ওই রক্তাক্ত বটমূল। সিএনএন-বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সব নিউজ চ্যানেলেই ওই খবর। টেস্ট সিরিজের আগে বাংলাদেশের তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচটি মনে হয় ওই দিনই শুরু হয়েছিল। ভারাক্রান্ত মন নিয়েও তাই মাঠে যেতে হলো। তবে একটাই বাঁচোয়া, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পত্রিকা ছুটি বলে লেখার কোনো ঝামেলা নেই। অনলাইনের যন্ত্রণায় এখন যেমন পত্রিকা বন্ধ হলেও লেখালেখি থেকে মুক্তি নেই, তখন তো আর তা নয়। পত্রিকা বন্ধ মানে পুরোই ছুটি। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। অথচ সেদিন এই গানই হারিয়ে গেছে দূরে কোথায়!

স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে ২০০৪ সালের ট্যুরগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে সেটিকে মনে হচ্ছে একটা অভিশপ্ত বছর। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে আগে যে কখনো একসঙ্গে রেখে দেখিনি। সে বছরেরই ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার খবরটাও পেয়েছিলাম ট্যুরেই।

২০০১-এর পর ২০০৪—এই দুই বছরের ভয়াল দুটি দিন এমনই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে এরপর অনেক বছর দেশের বাইরে ট্যুরে যাওয়ার সময় আমার ভয়-ভয় করত, না জানি এবারও দেশে কি-না-কি হয়! এমন কোনো কিছুই হয়নি, এমন ট্যুরই তো বেশি। কিন্তু মনে তো থাকে খারাপগুলোই।

ঘটনার গুরুত্ব ও ভয়াবহতার গুরুত্বের দিক থেকে এই দুটির সঙ্গে কোনো তুলনাই হয়তো চলে না, তবে ট্যুরে থাকা অবস্থায় দুঃসংবাদও তো কম পাইনি। ২০০৪ সালেই তো আরও তিনটি। এর দুটিই অবশ্য ব্যক্তিগত। অলিম্পিকের মাস দুয়েক আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে থাকতেই বাবুর গুরুতর অসুস্থতার খবর পেলাম। পৃথিবীর অন্য এক প্রান্ত, চাইলেই তাড়াতাড়ি ছুটে আসা যায় না। তিন-চার দিন পর ফিরে এসে বাবুকে পেয়েছিলাম, কিন্তু তা না পাওয়ার মতোই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর তা-ও শেষ করে আসতে পেরেছিলাম, এথেন্স অলিম্পিক যা পারিনি। বড় ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল শেষ তিন দিন বাকি থাকতেই।

আরও পড়ুন

স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে ২০০৪ সালের ট্যুরগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে সেটিকে মনে হচ্ছে একটা অভিশপ্ত বছর। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে আগে যে কখনো একসঙ্গে রেখে দেখিনি। সে বছরেরই ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার খবরটাও পেয়েছিলাম ট্যুরেই। ওই বুলাওয়েতেই। বাংলাদেশ তখন সেখানে সেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট খেলছে। বৃষ্টির কারণে টানা দ্বিতীয় দিন যেখানে খেলাই শুরু হতে পারেনি। সারা দিন হোটেলেই বন্দী। সেই হলিডে ইন হোটেল, তিন বছর আগে রমনার বটমূলে বোমা হামলার খবরটা পাওয়ার সময়ও যেখানে ছিলাম।

বইমেলা আর হুমায়ুন আজাদ প্রসঙ্গ ধরেই মনে পড়ে গেল অভিজিৎ রায়ের কথা। মুক্তচিন্তার ‘অপরাধে’ যেদিন তাঁকে জীবন দিতে হলো, সেই ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমি ছিলাম মেলবোর্নে। বিশ্বকাপে সেদিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ। সময় পার্থক্যের কারণে আগের দুঃসংবাদগুলো যেখানে দিনে-দিনে পেয়েছিলাম, একই কারণে এটি পেয়েছিলাম পরদিন।

এমন অপঘাতে হয়তো নয়, তবে অনেক প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদই পেয়েছি দেশের বাইরে কাজ করতে গিয়ে। বিখ্যাত অনেকেরও। দিন-ক্ষণ-খবরটা পাওয়ার মাধ্যম সবই হয়তো এ কারণে বেশি মনে আছে। যেমন হুমায়ূন আহমেদ। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের আগে আগে বেলফাস্টে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের সময় তাঁর মহাপ্রস্থান। সেদিন সকাল থেকেই বেলফাস্টে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ওসব দেশে এমন দিনগুলো এমনিতেই বিষণ্নতার চাদরে মোড়া থাকে। সেই দিনটিকে আরও বিষণ্ন বানিয়ে দিয়েছিল খবরটা।

কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছি! এবার মনে হয় শেষ করা দরকার। সকালে আরেকটি ২১ আগস্টে ঘুম ভাঙার পর থেকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের কথা খুব মনে পড়ছিল বলে সেদিন আমি কোথায় ছিলাম, কেমন ছিলাম—এটাই শুধু লিখতে চেয়েছিলাম। অথচ কথায় কথায় কত কিছু লিখে ফেললাম।

জীবন তো এমনই। অন্তহীন কথকতা...