সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য থাকলেও দুই দেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহী। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল আগামী রোববার ঢাকায় আসছে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছিল নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্তরে দুই দেশের মধ্যে সফর বিনিময় শুরু হবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরটি হচ্ছে।

বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই যে আমরা একমত হতে পারব, তা তো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাই।
হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত বিবৃতি সত্ত্বেও জো বাইডেনের চিঠি বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে। সরকার মনে করছে, আওয়ামী লীগ চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের বিষয়টিকে সেভাবে আর সামনে রাখছে না। ওয়াশিংটন থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর ‘নির্বাচন–পরবর্তী বোঝাপড়ার’ প্রতিফলন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যখন নির্বাচনের ইস্যুটি খানিকটা সরিয়ে রেখে বোঝাপড়া করতে চায়, বাংলাদেশের তাতে সম্মতি দেওয়াটা সমীচীন মনে করছেন কূটনীতিকেরা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, নির্বাচনের পর দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাংলাদেশেরও আগ্রহ রয়েছে। জো বাইডেনের চিঠি এবং ঢাকায় উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সফর ওয়াশিংটনের নানা মহলে বাংলাদেশের যোগাযোগের ফসল।

যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার। ওয়াশিংটনের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নির্বাচনের বেশ আগে থেকে শ্রম অধিকারসহ মানবাধিকার, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো সামনে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। সামনের দিনগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর পাশাপাশি মানবাধিকার ও সুশাসনের বিষয়গুলোও থাকবে।

বিশ্ব রাজনীতি যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ককে আলাদা করে দেখাটা জটিল হয়ে গেছে। ভূরাজনীতি ও ভূ–অর্থনীতি এক হয়ে গেছে। কাজেই একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নিয়ে সম্পর্ক বেশি এগোবে না।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক

ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাখার। ওই প্রতিনিধিদলে আরও থাকছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার। তাঁরা দুজনই আলাদা ফ্লাইটে আগামীকাল শনিবার ঢাকায় আসবেন।

ঢাকার কূটনীতিকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ পরিচালক এমন এক সময় ঢাকায় আসছেন, যখন প্রতিবেশী মিয়ানমারের সংঘাতের ধাক্কা বাংলাদেশের ওপর এসে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে এক সেমিনারে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় নানা ইস্যুর পাশাপাশি মিয়ানমারের পরিস্থিতি আলোচনায় গুরুত্ব পেতে পারে।

সামনের দিনগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর পাশাপাশি মানবাধিকার ও সুশাসনের বিষয়গুলোও থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ৫২ বছরের পথচলায় আমাদের দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে আমরা নানাভাবে একসঙ্গে কাজ করি। বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে আমরা একমত হতে পারব, তা তো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে চাই।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের খসড়া সূচি অনুযায়ী, এইলিন লুবাখার পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আগামী রোববার দুপুরে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করবেন। একই দিন বিকেলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের দুই সদস্য আফরিন আক্তার ও মাইকেল শিফার আগামীকাল শ্রমিকনেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

গত ৫২ বছরের পথচলায় আমাদের দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে আমরা নানাভাবে একসঙ্গে কাজ করি। বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে আমরা একমত হতে পারব, তা তো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে চাই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ

আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় ও মিয়ানমার পরিস্থিতি

নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে প্রথম উচ্চপর্যায়ের সফরে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্য সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সরকারের মনোযোগ রয়েছে। সুশাসন, মানবাধিকার এবং শ্রম অধিকারের মতো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ততা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। এর পাশাপাশি প্রতিরক্ষাবিষয়ক চুক্তি—জিসোমিয়া ও আকসা সইয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি রয়েছে।

মিয়ানমার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এক কূটনীতিক জানান, মিয়ানমারের চলমান সংঘাতের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। বিশেষ করে মিয়ানমারের পরিস্থিতি বাংলাদেশে কতটা প্রভাব পড়েছে, বাংলাদেশ বিষয়টি কীভাবে দেখছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল জানা-বোঝার চেষ্টা করতে পারে।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব রাজনীতি যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ককে আলাদা করে দেখাটা জটিল হয়ে গেছে। ভূরাজনীতি ও ভূ–অর্থনীতি এক হয়ে গেছে। কাজেই একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নিয়ে সম্পর্ক বেশি এগোবে না। বাংলাদেশের গুরুত্ব শুধু অর্থনীতির কারণে নয়, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণেও। ফলে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে মনোযোগ দিচ্ছে।