ডেইলি স্টারে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা, অজ্ঞাতনামা আসামি ৩৫০ থেকে ৪০০
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৩৫০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলা করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, হত্যাচেষ্টাসহ দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় মামলাটি করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, দাঙ্গা সৃষ্টি করে সরকারি কর্মচারীদের কাজে বাধা দেওয়া, ডেইলি স্টার কার্যালয়ে অবৈধভাবে ঢুকে কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো, হত্যার উদ্দেশ্যে অগ্নিসংযোগ ও অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ, অফিসের কাজে বাধা দিতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অনলাইনে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা দেওয়া এবং অন্তর্ঘাতমূলক কাজেরও অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় শুধু লুটপাট করা সম্পদের মূল্য ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা।
তেজগাঁও থানায় মামলা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে মঙ্গলবার পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর মোট ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হয় ডেইল স্টার। হামলাকারীরা ভাঙচুর-লুটপাটের পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় ডেইলি স্টার কার্যালয়।
মামলার বিবরণের বরাত দিয়ে তেজগাঁও থানার পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ৩৫০ থেকে ৪০০ অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা, দাহ্য পদার্থ নিয়ে মিছিল করে রাজধানীর পশ্চিম তেজতুরি বাজারের ৬৪–৬৫ দ্য ডেউলি স্টার কার্যালয়ে এসে হামলার চেষ্টা চালায়। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে তারা বেআইনিভাবে দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে সমবেত হয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী স্লোগান দেয়। ইতিমধ্যে কতিপয় অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেআইনি সমাবেশে উপস্থিত সন্ত্রাসীদের মব সৃষ্টির মাধ্যমে ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক পোস্ট প্রকাশ করে। রাত সাড়ে ১২টার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের উসকানিমূলক নির্দেশ পেয়ে পরস্পরের যোগসাজশে পত্রিকার অফিস ভবনের গেটের শাটার ও কাচ ভেঙে প্রবেশ করে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ভয়ভীতি দেখায়। সন্ত্রাসীরা কার্যালয়ের ভেতরে থাকা কর্মীদের মারধরের চেষ্টা করে। তারা কার্যালয়ের আসবাব ভাঙচুর এবং বিভিন্ন মালামাল লুট করে। আসামিরা ভবনের সামনের কাচ ভেঙে সোফা, টেবিল-চেয়ারসহ বিভিন্ন আসবাব, সরঞ্জাম ও নথিপত্র নিচে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মামলায় বলা হয়, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী আসামিরা জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ডেইলি স্টার প্রকাশনাকে বাধা দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত করে। হামলাকারীরা ভবনের বিভিন্ন তলায় রাখা পাঁচ কোটি টাকা দামের দুই শতাধিক কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরার লেন্স, টিভি স্ক্যানার, সার্ভার, প্রিন্টার, স্টুডিও, ইকুইপমেন্টসসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস; বিভিন্ন তলায় একাধিক লকারে থাকা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এরপর সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন তলায় থাকা ডেইলি স্টার সংবাদকর্মীদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা এবং ভবন ধ্বংসের জন্য আগুন দেয়। সন্ত্রাসীরা নিচতলা, দ্বিতীয় তলা এবং তৃতীয় তলা পুড়িয়ে দেয় এবং আগুনে ভবনের বাকি তলাগুলোতে থাকা সম্পদ সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে। আসামিরা ভবনের চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টমতলায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ ছাড়া হামলাকারীরা ভবনের অগ্নিনির্বিাপণব্যবস্থা, সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডশনিং সিস্টেম, লিফট ও বৈদ্যুতিক লাইনের ক্ষতি করে এবং বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ডের চেষ্টা চালায়। হামলাকারীদের আগুনে ডেইলি স্টার ভবনের তৃতীয় তলায় স্টোরে সংরক্ষিত হিসাব বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নথি, জাতীয় রাজস্ব বিভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করসম্পর্কিত যাবতীয় নথি এবং নিউজ পেপারের আর্কাইভ পুড়ে ভস্মীভূত হয়। আসামিদের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ডেইলি স্টার ভবনে মোট কয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টাকা। যাচাই–বাছাই শেষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। সন্ত্রাসীরা দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয় ও এর মূল্যবান সরঞ্জাম ভাঙচুর, সব নথিপত্র ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা ভবনের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলে। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী আসামিরা হামলার ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে একাধিক সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন) ক্যামেরা ও ডিভিআর ভেঙে ফেলে।
মামলায় আরও বলা হয়, একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের দেওয়া আগুন তীব্র আকার ধারণ করে। পাশের ভবনগুলোতেও আগুন ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়। আসামিরা ঘটনাস্থলে আসা ফায়ার সার্ভিসকে কাজে বাধা দেয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছাতে গেলে বাধা ও হুমকি দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি বাড়লে শুক্রবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে তারা ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যায়। এ ঘটনায় ডেইলি স্টার কার্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাঁদের মধ্যে চরম প্রাণনাশের আতঙ্ক দেখা দেয়। এ ঘটনা দণ্ডবিধির ১৮৬০-সহ বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪; সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর আওতায় পড়ে। সন্ত্রাসীদের ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে পরদিন শুক্রবার ডেইলি স্টার পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। ডেইলি স্টার অনলাইন সংস্করণের কার্যক্রম বন্ধ ছিল প্রায় ১৭ ঘণ্টা। এ হামলার সিসিটিভি ফুটেজ এবং গণমাধ্যমের ফুটেজ রয়েছে।