এলএনজি বন্ধে গ্যাসসংকট, দফায় দফায় লোডশেডিং

লোডশেডিং
প্রতীকী ছবি

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। গ্যাসের চাপ কমায় চুলা জ্বালাতে সমস্যায় পড়ছেন ভোক্তারা। গ্যাসসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। তাই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের একটি বড় অঞ্চলে লোডশেডিং বাড়ছে।

বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, বিদেশ থেকে আমদানি করে আনা এলএনজি ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। গতকাল শুক্রবারও এখান থেকে ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ায় গতকাল রাত ১১টায় দুটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়।

দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় গড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এতে সব সময়ই সরবরাহ–ঘাটতি থাকে। এক খাতে বন্ধ করে অন্য খাতে সরবরাহ বাড়ানোর (রেশনিং) মাধ্যমে ঘাটতি সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসে ২১৫ থেকে ২২০ কোটি ঘনফুট। এলএনজি বন্ধ হওয়ায় গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি বেড়ে গেছে।

গতকাল রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার কারণে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে আজ শনিবার গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। ঝড়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এই অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, অতি দ্রুত গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হবে।

তবে আজ পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড বলছে, এলএনজি সরবরাহ কমায় তিতাস অধিভুক্ত এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকবে। রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস। গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এ সংস্থা।

এদিকে গ্যাসের সরবরাহ কমায় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম, মেঘনাঘাট, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে গতকাল মধ্যরাত থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি তিন হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এতে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে বেশি করে।

দিনে এখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ১১ হাজার মেগাওয়াটের কম। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও এখন হচ্ছে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চলনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ সূত্র বলছে, এলএনজি সরবরাহ বন্ধের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তাই সব বিতরণ সংস্থাকে ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) নির্দেশনা মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে তারা। বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় করে এনএলডিসি। কোনো কারণে এতে বড় তারতম্য হলে অবকাঠামোতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, যেটাকে ট্রিপ বলা হয়। জাতীয় গ্রিডে ট্রিপ হলে দেশের বড় অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আজ দুপুরে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার প্রথম আলোকে বলেন, দিনে ১১০ কোটি ঘনফুট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ নেমে গেছে ৬০ থেকে ৭০ কোটি ঘনফুটে। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন

ঢাকায় লোডশেডিং দফায় দফায়

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে দফায় দফায় লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এমনকি সব সময় অগ্রাধিকার পাওয়া গুলশানের অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দুটি বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকা) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)।


আজ বেলা একটার দিকে ডেসকোর দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, তাদের বিতরণ এলাকায় চাহিদা ১ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ৮৩৫ মেগাওয়াট। এতে ৩২২ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে তাদের। ছোট ছোট একটি এলাকায় নির্দিষ্ট ফিডার থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ডেসকোর এমন ফিডার আছে ৫০০–এর মতো। এর মধ্যে ১২৯টি ফিডারের আওতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। সরবরাহ না বাড়লে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

আজ ডিপিডিসির দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, দুপুর ১২টায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১ হাজার ৭৭৯ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাওয়া গেছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এর ফলে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ডিপিডিসির ফিডার আছে ৮৫০টির বেশি। এর মধ্যে একটি বড় অঞ্চলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

প্রাণ বাঁচাতে সতর্ক থাকার অনুরোধ

সাময়িক বিদ্যুৎ–বিভ্রাট হতে পারে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে দুঃখ প্রকাশ করেছে পিডিবি। এতে বলা হয়, দুর্যোগকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালনব্যবস্থা নানাভাবে ব্যাহত হয়। এ ছাড়া বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিতরণ ও সঞ্চালনব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। বৈদ্যুতিক লাইনে ডালপালাসহ গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে বৈদ্যুতিক লাইন ও খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটে যান্ত্রিক ত্রুটি। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে গাছ সরানোসহ যান্ত্রিক ত্রুটি সারাতে কিছুটা সময় প্রয়োজন হয়। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ধরে রাখতে পিডিবির সব কারিগরি কর্মীরা তৎপর আছেন।

জনসাধারণকে সতর্ক করে পিডিবি বলেছে, বিদ্যুৎ প্রাণঘাতী। তাই বৈদ্যুতিক ছেঁড়া তারের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার জন্য সবাইকে বিশেষভাবে সতর্ক করা যাচ্ছে। ঝড় থেমে গেলেও কোনোভাবেই ছেঁড়া তার সরাতে নিষেধ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ–কর্মীরাই ছেঁড়া তারের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন। বৈদ্যুতিক ছেঁড়া তার দেখামাত্র নিকটস্থ বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করেছে পিডিবি।