প্রথম আলো: এ বছর ডেঙ্গুতে বাংলাদেশে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ও মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক পরিসরে এডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ধরন এবার কেমন?
হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন: আর্থ্রোপড পতঙ্গবাহী কোনো ভাইরাস মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে যদি কোনো রোগ তৈরি করে তাকে আর্বোভাইরাস বলা হয়। ডেঙ্গু হচ্ছে একটি আর্বোভাইরাস। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর আর্বোভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যেমন ২০১৯ সালের পর ২০২৩ সালে আমরা অনেক রোগী পাচ্ছি। এটা শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে, তা নয়। এটা বৈশ্বিক বাস্তবতা। এই বছর ডেঙ্গু লাতিন আমেরিকাকেও অনেক ভোগাচ্ছে। সেখানে লাখ লাখ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জুলাই পর্যন্ত ব্রাজিলে ২৩ লাখ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে, যা অস্বাভাবিক বেশি। ব্রাজিলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৭৬৯ জনের। বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীর যে সংখ্যাটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রকৃত সংখ্যা বাস্তবে বেশি। কারণ, রোগীসংক্রান্ত তথ্যের ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা আছে।
আমাদের দেশের সাম্প্রতিক কয়েকটা জরিপে ঢাকার ও ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোয় উচ্চ ঘনত্বে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। মহাখালী এলাকায় একটি ব্যক্তিগত জরিপে অতি উচ্চমাত্রায় পরিণত এডিস ইজিপ্টাই মশা দেখতে পেয়েছি। এডিস ইজিপ্টাই মশা অত্যন্ত অভিযোজনশীল মশা ও বিশ্বের ১৬৭টি দেশে পাওয়া গেছে। যেসব দেশে এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হচ্ছে, সেসব দেশেও উচ্চমাত্রায় এই মশা এবং এডিস এলবোপিকটাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য আমাদের শুধু মশার সংখ্যার বা ঘনত্বের দিকে দেখলে হবে না। আমাদের মশার জীববিজ্ঞানের দিকেও দেখতে হবে। আমরা জানি যে শুধু স্ত্রী মশা রক্ত পান করে। সে রক্ত পান করে তার খাবার হিসেবে নয়। রক্তের প্রোটিনগুলো তার ডিমের নিষিক্তকরণ ও পরিপক্বতার জন্য দরকার হয়। কিন্তু এডিস ইজিপ্টাই মশা রক্ত শুধু তার ডিমের জন্য পান করে না। সে তার খাবার হিসেবেও রক্তকে কাজে লাগায়। বেশির ভাগ মশার প্রজাতি যখন একেকটা ডিম্বস্ফোটন চক্রে মাত্র একবার রক্ত পান করলেই তুষ্ট থাকে। এডিস ইজিপ্টাই মশার একাধিকবার রক্ত পানের প্রয়োজন হয়। অভিযোজনের মাধ্যমে একসময়ে বনে-জঙ্গলে বাস করা এই মশা এখন পুরোপুরি শহুরে মশা এবং রক্তের জন্য সে পুরোপুরি মানুষের রক্তের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু এই মশার বারবার মানুষকে কামড়ানোর প্রয়োজন পড়ছে, তাই একটি ভাইরাসে আক্রান্ত মশা কিন্তু একাধিক মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র একটি মশা একাধিক মানুষের ডেঙ্গু আক্রান্তের জন্য দায়ী। প্রতি দশজন মানুষকে মাত্র একটি আক্রান্ত মশা আক্রান্ত করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
প্রথম আলো: এডিস মশা মোট মশার কত শতাংশ? আর এডিস কামড়ালে কি ডেঙ্গু অবধারিত? এডিস অন্য মশাগুলো থেকে ভিন্ন কোন কোন ক্ষেত্রে?
হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন: মোট মশার কত শতাংশ এডিস মশা, মোটাদাগে এটা বলা কঠিন। এ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশে ১২৬টি মশার প্রজাতি পেয়েছি। তার মধ্যে ২৬টি এডিস মশার অন্তর্ভুক্ত। এই ২৬টির মধ্যে দুটি প্রজাতি, এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস এলবোপিকটাস ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। এই দুই প্রজাতির ঘনত্ব নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। যেমন শহরাঞ্চলে যেখানে গাছপালা বা সবুজ অঞ্চল কম, সেখানে আপনি এডিস ইজিপ্টাই পাবেন, আর গ্রাম অঞ্চলে কিংবা যেখানে গাছপালা এবং সবুজ অঞ্চল বেশি সেখানে এডিস এলবোপিকটাস পাবেন। আবার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণের ওপরও মশার ঘনত্ব নির্ভর করে। এমনিভাবে মশার প্রজনন যেভাবে হয় সেখানে পানির গুণমানের ওপরও মশার ঘনত্ব নির্ভর করে।
এডিস মশা কামড়ালে যে ডেঙ্গু হবে, তা নয়। মশার লালাগ্রন্থিতে ভাইরাসের উপস্থিতি থাকলে সেই মশা কামড়ালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। একটি গবেষণায় ঢাকায় মশাকে ডেঙ্গু ভাইরাসমিশ্রিত রক্ত খাওয়ানোর পর ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাস মশার লালাগ্রন্থিতে উপস্থিত পেয়েছি। তবে এটি ল্যাবরেটরিতে প্রাপ্ত ফল, সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশে এই সংক্রমণের হার কম হয়।
প্রাকৃতিকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত মশার শতকরা হার একেক গবেষণায় একেক রকম দেখা গেছে। গবেষণাগুলোয় দেখা গেছে, শতকরা হারের বড় রকমের পার্থক্য। কোনো কোনো গবেষণায় ১ শতাংশের কম থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত এডিস মশায় ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাকৃতিক সংক্রমণ পাওয়া গেছে।
এডিস মশা অন্য মশা থেকে ভিন্ন। কারণ, এই মশা দিনে কামড়ায়। মশাটি মূলত পরিষ্কার পানিতে বংশবিস্তার করে। অন্যান্য মশা মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য পশুপাখি থেকেও রক্ত পান করে। কিন্তু এডিস ইজিপ্টাই মূলত মানুষের রক্ত পান করে। এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতি দুটি সহজে বোঝার উপায় হচ্ছে এদের গায়ে সাদা-কালো দাগ আছে। সাদা-কালো দাগযুক্ত আরেকটি মশা হচ্ছে আরমিজেরাস। কিন্তু আরমিজেরাস মশা আকারে অনেক বড় হয়।
প্রথম আলো: আপনার গবেষণায় দেখিয়েছেন, এডিস মশা কীটনাশকপ্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এটা কি শুধু ঢাকায় না, এর বাইরেও প্রমাণ আছে?
হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন: ২০২০ সালে প্রাথমিক গবেষণায় আমরা ঢাকার আটটি এলাকা এবং রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম থেকে এডিস ইজিপ্টাই মশার ডিম সংগ্রহ করি।
ডিমগুলো থেকে পরিপূর্ণ মশা পাওয়ার পর সেই মশাগুলো কীটনাশকপ্রতিরোধী হয়েছে কি না, তার পরীক্ষা করি। আমরা দেখতে পাই যে প্রতিটি এলাকার মশাই পাইরিথ্রয়েড কীটনাশক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত পারমেথরিন ও ডেলটামেথরিনের প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এমনকি আমরা দেখতে পাই যে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে সংগ্রহ করা এডিস অ্যালবো পিকটাস মশা পারমেথরিন কীটনাশকের প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। আমার সাম্প্রতিক গবেষণায় ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা এডিস ইজিপ্টাই মশা এসব কীটনাশকের তীব্র প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ পাই।
প্রথম আলো: ডেঙ্গু আমাদের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের ক্ষেত্রে একটি বাস্তবতা হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে এটি বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকে, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। কিন্তু একে সহনশীল পর্যায়ে আনতে আমরা কী করতে পারি?
হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন: ডেঙ্গু রোধে আগে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। মশার ক্ষেত্রে আমরা দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। একটি হচ্ছে, ঢাকার মশার মধ্যে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া। এর ফলে ডেঙ্গু ভাইরাস মশার মধ্য দিয়ে মানুষের দেহে যেতে পারবে না। উলবাকিয়া দিয়ে ডেঙ্গু ও মশা দুই-ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আবার পুরুষ মশাকে রেডিয়েশন দিয়ে বন্ধ্যা করে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে স্ত্রী মশা থেকে লার্ভা হবে না ও মশার সংখ্যা কমে যাবে।