আমরা সবচেয়ে ‘খারাপ ছাত্রদের’ দলে প্রথম হয়েছি

দেশে নারী-পুরুষ সমতা আনতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে।

দেশের কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৩৬ শতাংশ। এই হার গত ১০ বছরে তেমন বাড়েনি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগ বাড়াতে হলে ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই বেশ গর্বের সঙ্গে পত্রিকায় ছাপা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। অর্থাৎ, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে ভালো আছেন।

কোন কোন সূচক দেখে, কী বিবেচনায় নিয়ে, কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্যের মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে—তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ছাড়াই প্রতিবেদনটি আমাদের সবাইকে বেশ গর্বিত করে তোলে।

বাংলাদেশ কেন বাল্যবিবাহে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ, কেন এই দেশে পরিবহন বা জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা এত কম; কেন এই দেশে স্বামীর ঘরে নারী নির্যাতনের হার বেশি; শিক্ষা, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে নারীর অবস্থা কেন ভালো নয়, এ ধরনের যেকোনো প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা উঠলেই তখন একদল মানুষ খাবার টেবিলে, চায়ের আড্ডায়, সেমিনার সিম্পোজিয়াম কিংবা টক শোতে এমনভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রথম স্থানের অব্যর্থ যুক্তি তুলে ধরেন, যা শুনলে মনে হয়, এ দেশে আর জেন্ডার বৈষম্য বা লিঙ্গবৈষম্য নেই। যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে—এমন কোনো আন্তর্জাতিক সনদ আমরা পেয়ে গেছি।

সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে সেরা

ডব্লিউইএফ মূলত লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে চারটি দিক বিবেচনায় নিয়ে বছর বছর এই বৈশ্বিক প্রতিবেদন তৈরি করে। এই চারটি দিক হচ্ছে—অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগ; শিক্ষাগত যোগ্যতা; স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এ বছরও বিশ্বের ১৪৬টি দেশে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে এই বিশ্ব সংস্থা।

ডব্লিউইএফের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের যে হাল, তাতে নারী-পুরুষ সমতা অর্জন করতে ১৩২ বছর লেগে যাবে। আর আমরা যে অঞ্চলে প্রথম হয়েছি অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় সমতা অর্জন করতে লাগবে প্রায় ২০০ বছর, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে সাত দশক বেশি।’

প্রতিবেদনের এই একটি সূচকে আমরা শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে আছি। আমাদের দেশের ৫০ বছর বয়সের মধ্যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে নারী সরকারপ্রধান আছেন। তবে কেবল এই একটি সূচক যে কিছুতেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রমাণ করে না, তা যেমন আমরা জানি, তেমনি এই প্রতিবেদনেও সেটি উঠে এসেছে।

এই প্রতিবেদনে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, সাব-সাহারা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়া—এই আটটি অঞ্চলের মধ্যে তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এসব অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান গড় করেই বৈশ্বিক হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।

এই আটটি অঞ্চলের মধ্যে অনেক অনেক ধাপে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার নারী-পুরুষ সমতার সময় নির্ধারিত হয়েছে ১৯৭ বছর। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আমরা যখন এই অঞ্চলে প্রথম হয়েছি, তখন আসলে আমরা সবচেয়ে ‘খারাপ ছাত্রদের’ দলে প্রথম হয়েই নিজেরা নিজেদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছি।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত ১৪৬টি দেশের মধ্যে সামগ্রিকভাবে আমরা ছয় ধাপ পিছিয়ে তালিকায় ৭১তম হয়েছি, গত বছর অবস্থান ছিল ৬৫তম। ২০০৬ সালে এই প্রতিবেদন তৈরি শুরুর পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে আমরা যে সবচেয়ে ভালো ফল করছি, তার মূল কারণ হচ্ছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সূচকে আমাদের দারুণ ফল।

প্রতিবেদনের এই একটি সূচকে আমরা শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে আছি। আমাদের দেশের ৫০ বছর বয়সের মধ্যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে নারী সরকারপ্রধান আছেন। তবে কেবল এই একটি সূচক যে কিছুতেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রমাণ করে না, তা যেমন আমরা জানি, তেমনি এই প্রতিবেদনেও সেটি উঠে এসেছে। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে ৯২তম অবস্থানে রয়েছি। আর মন্ত্রিসভায় নারীর সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অবস্থান ১২৭তম।

সংসদে এখনো নারীর প্রতিনিধিত্ব অনেক কম

দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে লিঙ্গভিত্তিক সমতার অবস্থা বুঝতে ডব্লিউইএফের প্রতিবেদন দেখার প্রয়োজন পড়ে না। বরং সংসদের দিকে তাকালে আমরা নিজেরাই সেটি বুঝতে পারি। আমাদের সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ২৩টি আসনে নারী সংসদ সদস্যরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৪৮ প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৬৯ আসনে স্বতন্ত্রসহ ৬৮ নারী প্রার্থী ছিলেন। আনুপাতিক হারে এই সংখ্যা অনেক কম হলেও এই সংখ্যাই অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

রাজনৈতিক দলেও প্রতিনিধিত্ব কম

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিধিমালা প্রণয়নের সময় দলগুলোর সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের শর্ত দিয়েছিল। এরপর এক যুগ পার হয়ে গেলেও কোনো দলই সেই শর্ত পূরণের ধারেকাছে যেতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনকেও এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে দেখা যায়নি।

করোনার পর শিক্ষায় নজর দিতে হবে

ডব্লিউইএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষা একটি মাপকাঠি। বাংলাদেশ নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের সূচকে ভালো করেছে। তবে এতেও বৈশ্বিকভাবে আমাদের অবস্থান ১৪৬ দেশের মধ্যে ১২৩তম। প্রাথমিক শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বা নাম লেখানোর মাধ্যমে জেন্ডার সমতা অর্জন করে বাংলাদেশ একসময় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। এখন সেটি আর খুব উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে বিশ্বে বিবেচিত হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশের মতো বিশ্বের ৬৪টি দেশ প্রাথমিক শিক্ষায় এই সমতা শতভাগ অর্জন করে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, ৭৫ শতাংশ দেশই প্রাথমিক শিক্ষায় নাম লেখানোর সূচকে ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে।

এখন বরং শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান সুযোগ পাচ্ছে কি না, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার সংখ্যায় কেমন পার্থক্য আছে, এমন নানা পরিসংখ্যান দেখা হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জন্য আশাব্যঞ্জক খবর হচ্ছে, টারশিয়ারি এডুকেশন বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ও কারিগরি শিক্ষায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশের পয়েন্ট বেড়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পয়েন্ট বরং এবার কমেছে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান না থাকায়। এটা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।

করোনা মহামারিকালে দেশে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর পর ছেলেমেয়েদের ফিরে আসার হার কেমন, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি ঝরে পড়েছে কি না—এমন নানা শঙ্কার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ক সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের রেটিং কমে আসার এই তথ্য বেশ মনোযোগ দাবি করে। বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫ থেকে ৭১-এ নেমে আসার পেছনেও এর একটা ভূমিকা ছিল। কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের (নবম) মতোই স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২৯তম স্থানে অপরিবর্তিত আছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা অনেক পিছিয়ে

বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ করেছে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগসংক্রান্ত সূচকে। ২০২২ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ কমেছে। গত দুই বছরের সব জরিপেই দেখা গেছে, করোনা মহামারিকালে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ হারিয়েছেন। তবে নারীর ক্ষেত্রে সে হার কখনো কখনো দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেশি। দেশের কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতেই মাত্র ৩৬ শতাংশের মত। আরও হতাশার কথা হচ্ছে, এই হার গত ১০ বছরে তেমন বাড়েনি। আর শ্রমশক্তিতে অংশ নেওয়া নারীদের ৯০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত। এ খাত থেকে ঝরে পড়া নারী শ্রমিকের প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করা সত্যিকার অর্থে অসম্ভব।

নিজ অঞ্চলে সেরার স্থানে থাকার খবর যেমন আমরা প্রতিবছর উদ্‌যাপন করছি, ঠিক তেমনি লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি এক জায়গায় থেমে যাচ্ছে কি না, আমরা প্রত্যাশিত গতিতে এগোতে পারছি কি না—এসব বিষয় নিয়েও আমাদের ভাবনা থাকা জরুরি।

শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগ বাড়াতে হলে ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। যেমন জনপরিসরে ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। এটি নিশ্চিত করা গেলে ছাত্রীকে বখাটের হাত থেকে বাঁচাতে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগে বিয়ে দিতে হবে না। নিরাপত্তা ও শিক্ষা বাড়লে নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ অবারিত হবে। এর ফলে নারীকে পরিবার যেমন বোঝা মনে করবে না, তেমনি তাকে পারিবারিক নির্যাতন সয়ে টিকে থাকতে হবে না।

চাই সরকারি বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার

এসব তত্ত্ব হয়তো বাস্তবে এমন সোজাসাপটা নয়। তবে মোটাদাগে নারীর অবস্থার পরিবর্তন একটির সঙ্গে আরেকটি ভীষণভাবে যে সম্পৃক্ত, তা সরকার মাথায় রেখেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ দিচ্ছে। নারীর নিরাপত্তা, আবাসন, শিশু যত্নকেন্দ্র তৈরিসহ নারীদের কল্যাণে নানা ক্ষেত্রে এখন সরকারি বরাদ্দ আছে। কোথায় কোন কাজটা করতে হবে, এখন হয়তো তার একটি সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা দরকার, যে রোডম্যাপ ধরে বাংলাদেশ লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জনের পথে ২০০ বছরের অনেক কম সময়েই অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।

২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দৌড়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে। একসময় প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ ভর্তি, সবার জন্য টিকা এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবহারে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। এবার লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জনের পথেও সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারবে বাংলাদেশ—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

নবনীতা চৌধুরী, পরিচালক, জেন্ডার কর্মসূচি, ব্র্যাক