দেশেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের টাইলস, বড় হচ্ছে বাজার
আবাসনশিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো টাইলস। শুধু মেঝে নয়; বরং দেয়াল, সিঁড়ি, রান্নাঘর, এমনকি বাথরুম ও আউটডোর স্পেসেও টাইলস ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। একসময় বাড়ি নির্মাণে মার্বেল বা সিমেন্টই ছিল প্রচলিত উপাদান। টাইলস এখন সেই জায়গা দখল করেছে। কারণ, এটি শুধু সৌন্দর্যই বাড়ায় না; বরং সহজে পরিষ্কার করা যায়, টেকসই হয় এবং বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের কারণে যেকোনো জায়গাকে আধুনিকভাবে সাজাতে সাহায্য করে। ফলে আবাসনের নান্দনিকতায় টাইলস এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শহর ছাড়িয়ে মফস্সল, এমনকি গ্রামাঞ্চলে নির্মিত ভবনেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে টাইলস।
টাইলস শিল্পের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে টাইলস শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার। গত এক দশকে এই শিল্পের প্রবৃত্তি ছিল ২০ শতাংশ। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যাসহ বেশ কিছু কারণে বর্তমানে এই হার হ্রাস পেয়েছে। সেই সঙ্গে গ্যাসের দাম ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিও এই হার হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকার ফলে দেশের কারখানাগুলোতে নিয়মিত উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। যেহেতু এটি শতভাগ গ্যাসনির্ভর একটি শিল্প, তাই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ অত্যাবশ্যক। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রুচির পরিবর্তন এবং রাজধানীর বাইরে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে টাইলসের বাজার বড় হচ্ছে। শেয়ার বাড়ছে দেশীয় কোম্পানিগুলোর।
ডিবিএল সিরামিকসের হেড অব সেলস মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান রাজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের টাইলস শিল্পকে এগিয়ে নিতে এখন সবচেয়ে জরুরি হলো সরকারের ব্যবসাবান্ধব নীতি ও সহায়তা। যেহেতু এই শিল্প মূলত আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল, তাই শুল্ক কাঠামো, ব্যাংকিং সুবিধা ও কাঁচামালের দামে ভারসাম্য আনতে হবে। এতে দেশের টাইলস ইন্ডাস্ট্রি শক্তিশালী হবে এবং বিদেশি টাইলসের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।
মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান রাজ আরও বলেন, একই সঙ্গে কোম্পানিগুলোকেও নিজেদের উদ্যোগে নতুন ডিজাইন ও ইনোভেশন আনা, ডিলার নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপস্থিতি বাড়ানো জরুরি। গুণমান ও সেবায় ধারাবাহিকতা থাকলেই টাইলসের বাজার আরও প্রসারিত হবে।
ট্রেন্ডস ও পরিবর্তন
বর্তমানে ভোক্তারা শুধু কার্যকারিতা নয়, বরং নান্দনিকতাকেও প্রাধান্য দেন। আগে যেখানে একরঙা সাধারণ টাইলস জনপ্রিয় ছিল, এখন ডিজাইন, টেক্সচার ও ফিনিশিংয়ের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। উডেন ফিনিশিংয়ের কাঠের মতো ডিজাইন, মার্বেল টেক্সচার, গ্রাফিক ডিজাইন কিংবা থ্রিডি প্যাটার্নের টাইলস ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি বাজারে এখন অ্যান্টি-স্লিপ টাইলস, হিট-রেসিস্ট্যান্ট টাইলস এবং হাই-ডিউরেবল গ্লেজড টাইলসের চাহিদা বেড়েছে।
বাংলাদেশের টাইলস শিল্পে বর্তমানে একাধিক প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ডিবিএল সিরামিকস, আরএকে সিরামিকস, স্টার সিরামিকস, আরএফএল সিরামিকস, মিরপুর সিরামিকস ইত্যাদি শীর্ষস্থানীয় নাম। বর্তমানে দেশের ভেতরে ৩০টির বেশি বড় কারখানা টাইলস উৎপাদনে নিয়োজিত, যেখানে প্রতিদিন কয়েক লক্ষাধিক বর্গফুট টাইলস তৈরি হচ্ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখতে প্রযুক্তি উন্নয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিটি ব্যাচ বাজারজাত করার আগে মান পরীক্ষার কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। ফলে বর্তমানে উৎপাদিত টাইলসের মান আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো। ডিজাইনেও তারা পিছিয়ে নেই। প্রতিবছর নতুন ডিজাইন ও প্যাটার্ন যুক্ত করা হয়। আধুনিক ফ্লোর টাইলস থেকে শুরু করে ওয়াল টাইলস, আউটডোর টাইলস—এমনকি বিশেষ আর্কিটেকচারাল টাইলসও তৈরি হচ্ছে দেশীয় কারখানায়।
টাইলসের দাম
টাইলসের দাম অনেকাংশে নির্ভর করে ব্র্যান্ড, সাইজ, ডিজাইন ও গুণমানের ওপর। সাধারণত টাইলস বিক্রি হয় বর্গফুট হিসেবে। বাংলাদেশে টাইলসের দাম নির্ভর করে আকার, ধরন ও ব্র্যান্ডের ওপর। বাজারে ফ্লোর বা মেঝের জন্য ৩২ বাই ৩২, ২৪ বাই ২৪, ১৬ বাই ১৬, ২৪ বাই ৪৮ ইঞ্চির মাপের টাইলস এখন বেশি জনপ্রিয়।
মেঝের টাইলসের মতো দেয়ালেও সিরামিক টাইলস ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দেয়ালে ব্যবহৃত টাইলস তুলনামূলক পাতলা ও কম শক্তিশালী হয়ে থাকে। তাই দেয়ালে ব্যবহারের টাইলসগুলো হয় সাধারণত ১২ বাই ২৪, ১২ বাই ৩২, ১২ বাই ৪৮, ১০ বাই ১৬, ৮ বাই ১২ ইঞ্চির।
দেশের টাইলস শিল্পের ভবিষ্যৎ
ডিবিএল সিরামিকসের হেড অব সেলস মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান রাজ বলেন, ‘বাংলাদেশের টাইলস শিল্পের ভবিষ্যৎ আমি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করি। দেশের নগরায়ণ, আবাসন ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে টাইলসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। দেশীয় কারখানাগুলো আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও ডিজাইন অর্জন করছে, ফলে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমছে এবং রপ্তানির সুযোগ বাড়ছে। আগামী দিনে গ্রাহকেরা আরও টেকসই, নান্দনিক এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য চাইবেন আর আমাদের শিল্প সেই দিকেই এগোচ্ছে।’
মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান রাজ আরও বলেন, সঠিক কৌশল, ধারাবাহিক বিনিয়োগ এবং দক্ষ মানবসম্পদ থাকলে বাংলাদেশের টাইলস শিল্প দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে পারবে।