‘কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়’

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউএন এনভায়রনমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম আলো আয়োজিত ‘এসডিজি প্রচারাভিযান-২০২২: যুব ও নারীদের বলিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা। জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রামছবি: সৌরভ দাশ

কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে প্রত্যেক মানুষেরই অবদান দরকার। আর প্রতিবন্ধীরা এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে প্রতিবন্ধীসহ পিছিয়ে পড়া সব জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে আত্মোন্নয়ন ঘটাতে হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে চট্টগ্রামে প্রচারাভিযানের মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নিয়ে এভাবেই নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন প্রতিবন্ধী বেলাল হোসেন।

আজ মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম নগরে শিল্পকলা একাডেমিতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউএন এনভায়রনমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম আলো আয়োজিত ‘এসডিজি প্রচারাভিযান-২০২২: যুব ও নারীদের বলিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে অংশগ্রহণকারী যুব ও নারীদের নিয়ে একটি শোভাযাত্রা বের হয়। চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়া এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের ঝাউতলা বস্তিতে প্রতিবন্ধী বেলাল হোসেনের বসবাস। ‘প্রতিবন্ধী একত্রিত সংগঠন’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের পরিচালক তিনি। শুধু বেলাল নন, তাঁর মতো আরও বেশ কয়েকজন সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও তরুণ-যুবারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা অনুষ্ঠানে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে অবদান রাখার শপথ নেন।

সকাল নয়টায় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়া শোভাযাত্রা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে এসডিজি-সম্পর্কিত স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েক শ মানুষ। পাশাপাশি ছিলেন প্রথম আলো বন্ধুসভার বিভিন্ন অঞ্চলের বন্ধুরা। আয়োজনে সহযোগিতাও করেছে বন্ধুসভা। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শোভাযাত্রা শেষ হয়। পরে মিলনায়তনে শুরু হয় আলোচনা, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, বারোয়ারি বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। পাশাপাশি শিল্পকলা প্রাঙ্গণে চলতে থাকে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।

চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একাংশ। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সৌরভ দাশ

আলোচনা অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রচারাভিযানের সফলতা কামনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন দেশের যুব ও নারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রথম আলো ও ইউএনডিপি দেশব্যাপী একটি প্রচারাভিযান শুরু করেছে। কাজটি এ দেশের নারী ও যুবকদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি এ কাজের সঙ্গে আছেন, থাকবেন।

বন্ধুসভার জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিকের সঞ্চালনায় আলোচনার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। এরপর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য দেন সচেতন নাগরিক কমিটি, চট্টগ্রামের সহসভাপতি রওশন আরা চৌধুরী, প্রান্তিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম সারোয়ার, শিক্ষাবিদ ও আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম, ইউএনডিপি বাংলাদেশের সিনিয়র গভর্ন্যান্স স্পেশালিস্ট শীলা তাসনীম হক, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ ও বন্ধুসভা চট্টগ্রামের সভাপতি শিহাব জিসান।

অনুষ্ঠানে এসডিজি-বিষয়ক নানা তথ্য উপস্থাপনা করেন ইউএনডিপির এসসিফোরএসডিজি প্রকল্প সহযোগী ফারহানা রাজ্জাক। অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের হেড অব কমিউনিকেশনস মো. আব্দুল কাইয়ুম।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ। বেলা একটায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সৌরভ দাশ

‘এগিয়ে যেতে হবেই’

সূচনা বক্তব্যে সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, গত শতকের সত্তর বা আশির দশকে দরিদ্র ও নিরক্ষর নারীরা পোশাকশিল্পে পা রেখেছিলেন। এখন পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় জায়গা দখল করেছে। তরুণ ও যুবকেরা মাছ চাষ করেছেন, উদ্যোক্তা হয়েছেন, কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ কারণে এসব খাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৈরি হয়েছে। ফলে এ কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়, নারী ও যুবারা সুযোগ পেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, যাচ্ছেন। কলসিন্দুরের মেয়েরা বাধা অতিক্রম করে দেখিয়ে দিয়েছেন। দেশকে সম্মান এনে দিয়েছেন। ফলে এগিয়ে যেতে হবেই।

নারীরা এখনো অনেক জায়গায় পিছিয়ে আছেন বলে মন্তব্য করেন রওশন আরা চৌধুরী। তিনি বলেন, নিজেকে তৈরি করতে হবে। নারী-পুরুষের সমতা আনতে হবে।

কোনো বাধা মানা যাবে না। নেতৃত্বচর্চার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আর লক্ষ্য ঠিক করে কাজ করলে সফলতা আসবেই, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যা কাজে দেবে।

অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা। বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সৌরভ দাশ

প্রান্তিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা জরুরি। জলজ সম্পদের বিপুল বৈচিত্র্য রয়েছে বিশ্বব্যাপী। এসব সম্পদ নষ্ট করা যাবে না।

শিক্ষাবিদ আনোয়ারা আলম দারিদ্র্য বিলোপ, লিঙ্গসমতা, অসমতাসহ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নানা ধাপ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। মোদ্দাকথা, সব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যুবসমাজকে এগিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়সীমা আর বেশি দিন নেই।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের সিনিয়র গভর্ন্যান্স স্পেশালিস্ট শীলা তাসনীম হক বলেন, যুব-নারীসহ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব। কাউকে বাদ দিয়ে এগোনো যাবে না। আর এগিয়ে যেতে হলে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করা ছাড়া উপায় নেই। নেতৃত্বের চর্চা করতে হবে।

শীলা তাসনীম হক আরও বলেন, এসডিজি অভীষ্ট অর্জনে জনসম্পৃক্ততা, বিশেষ করে নারী-যুবাদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব ছড়িয়ে দিতে এ প্রচারাভিযানের আয়োজন করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এসডিজির নানা খুঁটিনাটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

নাটক পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুরা। মঙ্গলবার বেলা দুইটায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সৌরভ দাশ

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘এখন পৃথিবীর মানুষ একে অপরের সঙ্গে পরস্পর যুক্ত হয়ে আছেন। পরিবেশের সঙ্গেও মানুষ যুক্ত হয়ে আছেন। কিন্তু শুরুতে এ রকম ছিল না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। সেটার প্রভাব এ দেশেও পড়েছে। আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের রান্নাঘরে যখন খাবার তৈরি হয়, তখন তাদের মনে রাখতে হয় যে ওই খাবার হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন—সবাই খাবে।

এ রকম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পৃথিবীর মুখোমুখি আমরা আগে হইনি। ফলে আমাদের একার সিদ্ধান্ত কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীর সব মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।’
তরুণ ও যুবাদের উদ্দেশ্যে কবি সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘আপনারা এখন যা করবেন, সেটার ফল ভোগ করবে পরবর্তী প্রজন্ম। ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ছোট উদ্যোগ বড় পরিবর্তন আনতে পারে। কলসিন্দুরের মেয়েদের জন্য পুরো জনপদে পরিবর্তন এসেছে। প্রথম আলোতে এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। খাবারের জন্য কলসিন্দুরের সেই মেয়েরা ফুটবল খেলত। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। নানা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে তারা সাফে জয় পেয়েছে। তারা বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে।’

চিত্রাঙ্কন ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সঙ্গে অতিথিরা। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সৌরভ দাশ

নারীর ক্ষমতায়ন, সমতা প্রতিষ্ঠার মতো মূল্যবোধ প্রথম আলো ধারণ করে বলে জানান সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অর্ধেক নারী। বাংলাদেশেও তাই। এসডিজির এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো আমরা ধারণ করি। এসব আমাদের নিজেদের মূল্যবোধেরই অংশ।’

পুরস্কার পেল যারা

কেউ এঁকেছে ঘরবাড়ি। কারও পেনসিলে ধরা দিয়েছে সবুজে মোড়ানো পাহাড়ের বুকে উড়ে যাওয়া পাখির দল। কেউ আবার মানুষের উল্লাস এঁকে বিচারকদের মন কেড়েছে। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রংতুলিতে নিজের কল্পনাকে রাঙিয়েছে। পরে তাদের মধ্যে তিনজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির নাজরাবীন বিনতে মোর্শেদ। দ্বিতীয় হয়েছে সিডিএ পাবলিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির নুসাইবা হাসান ও তৃতীয় পুরস্কার জিতে নেয় পূর্ব নাসিরাবাদ এ জলিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির মৌ বিশ্বাস। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সুব্রত দাশ, তাসলিমা আক্তার ও বিজেসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জয়শ্রী দাশ।

প্রথম আলো ও ইউএনডিপির যৌথ আয়োজনে ‘এসডিজি প্রচারাভিযান-২০২২: যুব ও নারীদের বলিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া যুব ও নারীদের একাংশ। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সৌরভ দাশ

এ ছাড়া বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন দৃষ্টি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ বকুল, জাতীয় বিতার্কিক হাসান মাহমুদ ও বিতার্কিক মুমু দাশ। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মূর্ছনা চক্রবর্তী, দ্বিতীয় হন চট্টগ্রাম কলেজের নাজিফা তাজনূর এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র তানভিরুল আলম।

আয়োজকেরা জানান, ১৯ নভেম্বর রাজশাহী থেকে এই প্রচারাভিযানের শুরু হয়। এরপর সিলেটে অনুষ্ঠান হয়েছে। সবশেষ ঢাকায় এ বিষয়ে বড় কর্মসূচি রয়েছে।