শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট: তহবিলে টাকা থাকলেও পাচ্ছেন না অসচ্ছল শিল্পীরা

দেশের অসচ্ছল শিল্পীদের কল্যাণসাধন, শিল্পীদের কল্যাণার্থে প্রকল্প অনুমোদন-বাস্তবায়নের মতো লক্ষ্য নিয়ে প্রায় দুই বছর আগে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন যাত্রা শুরু করে ‘বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট’। ট্রাস্টের মূল তহবিলে এখন জমা আছে ৩৫ কোটি টাকা। ট্রাস্ট থেকে এখন পর্যন্ত তিন দফায় শিল্পীদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অসচ্ছল শিল্পী বা সংস্কৃতিসেবীদের আর্থিক সাহায্যের জন্য ট্রাস্ট থেকে কোনো বিজ্ঞপ্তি এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ফলে অসচ্ছল শিল্পীদের কেউ ট্রাস্ট থেকে অর্থসহায়তা পাননি। ট্রাস্ট ‘আসল’ কাজই করছে না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, ট্রাস্টের নীতিমালা এখনো অসম্পূর্ণ। বিধিমালায় আছে দুর্বলতা। জনবলও নেই। এসব বিষয়ে দ্রুত সমাধান হবে। তখন অসচ্ছল শিল্পীদের অর্থসহায়তার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া যাবে।

অন্যদিকে শিল্পীরা বলছেন, দেশে অনেক অসচ্ছল শিল্পী আছেন। তাঁদের অর্থসহায়তা দরকার, কিন্তু এই ট্রাস্টের খবর অসচ্ছল শিল্পীরা জানেনই না।

ট্রাস্টের কাজ

বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০০১-এর আওতায় ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করে ‘বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট’। এর আগে ২০২০ সালে শিল্পী কল্যাণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।

আইনের ৭ নম্বর ধারায় ট্রাস্টের কার্যাবলির উল্লেখ আছে। যথাক্রমে ট্রাস্টের কার্যাবলিগুলো হলো অসচ্ছল শিল্পীদের কল্যাণসাধন। শিল্পীদের কল্যাণার্থে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন। পেশাগত কাজ করতে অক্ষম-অসমর্থ শিল্পীকে আর্থিক সাহায্য। অসুস্থ শিল্পীর চিকিৎসার ব্যবস্থা বা আর্থিক সাহায্য। শিল্পকর্মে বিশেষ অবদানের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা। শিল্পীদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য এককালীন মঞ্জুরি, বৃত্তি বা স্টাইপেন্ড প্রদান। দুর্ঘটনায় কোনো শিল্পীর মৃত্যু হলে পরিবারকে সাহায্য। উল্লেখিত কাজ সম্পাদনের জন্য যেকোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আইনের উদ্দেশ্য পূরণে অন্য যেকোনো কাজ করা।

সূত্র জানায়, ট্রাস্ট থেকে এখন পর্যন্ত তিন দফায় শিল্পীদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিল্পকর্মে বিশেষ অবদানের জন্য দুই দফায় দুজন শিল্পী এমফিল করার জন্য বৃত্তি পেয়েছেন। কিন্তু কোনো অসচ্ছল শিল্পী এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পাননি।

এ প্রসঙ্গে ট্রাস্টের সদ্যবিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসীম কুমার দে গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তহবিলে এখন সুদসহ ৩৫ কোটি টাকা আছে, যা এফডিআর (ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে সুদের হার) করে রাখা হয়েছে। তবে নীতিমালা করা হয়েছে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। যেহেতু সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অসচ্ছল শিল্পীদের সাহায্য দেওয়া হয়, তাই একই মন্ত্রণালয়ের অধীন আরেকটি তহবিল থেকে সহযোগিতা করা হয় না।

কত টাকা বৃত্তি

ট্রাস্ট থেকে ২০২৩ সালে ৩ দফায় শিল্পীদের ২৭৮ জন সন্তানকে (ষষ্ঠ থেকে স্নাতকোত্তর) শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় পেয়েছে ৮০ জন, দ্বিতীয় দফায় ৬২ ও তৃতীয় দফায় ১৩৬ জন।

বৃত্তির আওতায় ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাসে ১ হাজার টাকা, স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন মাসে ২ হাজার টাকা করে।

বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র–ছাত্রীরা কে কোন শ্রেণির শিক্ষার্থী, তার উল্লেখ ট্রাস্টের ওয়েবসাইটে থাকা তালিকায় নেই।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে শিল্পীদের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তির চতুর্থ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ট্রাস্ট। একই সঙ্গে শিল্পকর্মে বিশেষ অবদানের জন্য শিল্পীকে এমফিল/পিএইচডি করার লক্ষ্যে বৃত্তির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।

ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, কেউ আবেদন করছেন, মানে তাঁর প্রয়োজন আছে। তবে শিল্পীদের মেধাবী সন্তানদের বৃত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনার কোনো নীতিমালা নেই।

২০২২ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অসীম কুমার দে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে থেকে সম্প্রতি তিনি অবসরে যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সালে ট্রাস্ট থেকে তিন দফায় শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে প্রচার-প্রচারণার জন্য। ভবিষ্যতে বছরে একবার করেই শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হবে।

অসচ্ছল শিল্পী অর্থ পাচ্ছেন না

দেশে অসচ্ছল শিল্পীর সংখ্যা কত, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে শিল্পীদের আর্থিক সংকটে থাকা, অর্থের অভাবে চিকিৎসা না হওয়ার খবর প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে।

ট্রাস্টের অর্থ অসচ্ছল শিল্পীদের জন্য কেন ব্যবহার করা যাচ্ছে না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাস্টের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা এখনো হয়নি। ২০২০ সালে প্রণীত বিধিমালায় কিছু দুর্বলতা আছে। ট্রাস্টের লোকবল একেবারেই নেই। এসব কারণে অসচ্ছল শিল্পীদের অর্থসহায়তার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নতুন প্রতিমন্ত্রী এসেছেন। এসব বিষয়ে দ্রুতই সমাধান হবে।

শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের পরিস্থিতি জানিয়ে নাট্যজন মামুনুর রশীদের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে অনেক অসচ্ছল শিল্পী আছেন, যাঁদের টাকা দরকার। কিন্তু আমরা তো জানি না, অসচ্ছল শিল্পীদের জন্য ট্রাস্টে টাকা বরাদ্দ আছে। এটা প্রকাশ্য হওয়া উচিত। আসল কাজটি না করে (অসচ্ছল শিল্পীদের অর্থ সাহায্য) শিল্পীদের সন্তানদের পড়ালেখা বাবদ মাসে কিছু টাকা দিলে তা সম্পূর্ণ অপচয়। এই টাকায় কি লেখাপড়া হয়? নীতিমালায় দুর্বলতা থাকলে দ্রুতই তা সমাধান করে অসচ্ছল শিল্পীদের সহযোগিতার অর্থ তাঁদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হোক।’