বিসিএস পাস ও অ্যাডহক চিকিৎসকদের দ্বন্দ্ব

মাঠপর্যায়ে বিসিএস পাস করে নিয়োগ পাওয়া ও অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া ১ হাজার ৯৮৯ জন চিকিৎসকে প্রমার্জনা দিয়ে স্থায়ী ও জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে বৈষম্যের শিকার হবেন বলে মনে করছেন বিসিএস পাস করা ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকেরা।

বিসিএস পাস করা ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকেরা অভিযোগ করছেন, অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া কিছু চিকিৎসককে সুবিধা দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভুল তথ্য দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। আদালতে একটি চলমান মামলার কথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি।

২০১০ সালে ৩ হাজার ৫৫১ জন ও ২০১১ সালে ৫৮২ জন মোট ৪ হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসককে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসকদের সূত্রগুলো বলছে, বিগত কয়েক মাসে নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, শরীয়তপুর, ভৈরব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই দুই ধরনের চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।

খুলনার একটি উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিসিএস পাস করা ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকেরা বেশ কয়েক ধরনের পরীক্ষা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে পদোন্নতি পান। কিন্তু অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের এসবের কোনো কিছুই প্রয়োজন হচ্ছে না। এই ব্যবস্থা ক্যাডারভুক্ত বিসিএস পাস করা চিকিৎসকেরা মেনে নিতে পারছেন না।’

২০১০ সালে ৩ হাজার ৫৫১ জন ও ২০১১ সালে ৫৮২ জন মোট ৪ হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসককে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের পদ ছিল মেডিকেল কর্মকর্তা, গ্রেড ছিল নবম। এঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। ১ হাজার ৯৮৯ জনের মধ্যে কেউ বিসিএস পরীক্ষা দেননি, কেউ কেউ বিসিএস পাস করতে পারেননি বা কারও বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বয়স ছিল না। তাঁরা অ্যাডহক অবস্থায় চাকরিতে থেকে গেছেন।


এই ১ হাজার ৯৮৯ জনকে ২০১৪ সালে নন-ক্যাডার পদে নিয়মিতকরণ ও স্থায়ীকরণ করা হয়। চাকরি স্থায়ীকরণ করা হলেও সরকার নির্ধারিত পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই ৪৩০ জনকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরপর ২০২২ সালে তাঁদের সবাইকে ক্যাডারভুক্ত করা হয়।

আমি ১৩ বছর সরকারি চাকরি করছি। সরকার আমাকে ক্যাডারভুক্ত করেছে। আমি ষষ্ঠ গ্রেডের যোগ্য।
নন্দলাল সূত্রধর

বৈষম্য কোথায়

২০১০ ও ২০১১ সালে অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের অর্ধেকের বেশি ৩০, ৩১ ও ৩৩তম বিসিএস পাস করে ক্যাডারভুক্ত হন। বিসিএস পাস করা কেউ কেউ এখনো নবম গ্রেডের কর্মকর্তা, অধিকাংশ সপ্তম গ্রেডের কর্মকর্তা। এমনকি ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তা এখনো সপ্তম গ্রেডে আছেন। অন্যদিকে অ্যাডহকের কর্মকর্তার পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়ার নজিরও আছে। কেউ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উপ-কর্মসূচি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

নন্দলাল সূত্রধর ২০১১ সালে অ্যাডহকে নিয়োগ পান। এখন তিনি পুষ্টি কর্মসূচির উপকর্মসূচি পরিচালক। ওই পদটি ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তার। নন্দলাল সূত্রধর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১৩ বছর সরকারি চাকরি করছি। সরকার আমাকে ক্যাডারভুক্ত করেছে। আমি ষষ্ঠ গ্রেডের যোগ্য।’

দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে ৪৯৩টি। এর মধ্যে প্রায় ১০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা অ্যাডহকে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁরা সবাই ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা। এসব উপজেলায় বিসিএস পাস করা এবং অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্ব চলছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিতে ত্রুটি

১ হাজার ৯৮৯ জনের চাকরি স্থায়ী করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি গেছে। প্রথম চিঠি যায় ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উত্তরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগবিধি অনুসরণ করে ক্যাডারভুক্ত পদে চাকরি স্থায়ীকরণ করতে হবে। বিধিতে বলা আছে, স্থায়ী হতে হলে সময়-সময় প্রশিক্ষণে ও পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে এবং পরীক্ষায় পাস করতে হবে।


একই বছর ১৮ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আবার একটি চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এবং এতে চাকরির অভিজ্ঞতা প্রমার্জনাসহ চিকিৎসকদের সিনিয়র স্কেল দেওয়ার কথা বলে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আবারও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগবিধি মেনে চলার কথা বলে।

ক্যাডার, নন-ক্যাডার, অ্যাডহক তাঁরা সবাই চিকিৎসক। আমি সব চিকিৎসকেরই অভিভাবক। আমি সকলের সুবিধা-অসুবিধা সমানভাবে দেখতে চাই।
সামন্তলাল সেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সর্বশেষ ও তৃতীয় চিঠি যায় ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর। তাতে চিকিৎসকদের চাকরি স্থায়ীকরণের শর্তাবলি প্রমার্জন করার অনুরোধ করা হয়।
এই প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার জন্য চলতি বছরের ৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খালেদ আহমেদুর রহমান। চিঠিতে তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মিথ্যা তথ্য দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে।


খালেদ আহমেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যাডহক ভিত্তিতে নেওয়া চিকিৎসকদের পদোন্নতি ও চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যাপারে আদালতে মামলা চলছে। বিষয়টি নিয়ে যে একটি মামলা চলছে, তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে লুকিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো চিঠিতে মামলার কথা উল্লেখ নেই।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন অতিরিক্ত সচিব প্রথম আলোকে বলেন, কোনো মামলা থাকলে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাতে হয়। মামলার কথা জানা থাকলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আদালত অবমাননার ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়।

দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে ৪৯৩টি। এর মধ্যে প্রায় ১০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা অ্যাডহকে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁরা সবাই ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা। এসব উপজেলায় বিসিএস পাস করা এবং অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্ব চলছে।

অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, অ্যাডহকে নিয়োগ হলেও পরীক্ষা দিয়ে তাঁরা চাকরিতে ঢুকেছেন। তাঁরা বহু বছর চাকরি করেছেন। স্থায়ী চাকরি ও জ্যেষ্ঠতা তাঁদের প্রাপ৵। অন্যদিকে বিসিএস পাস করা চিকিৎসকদের বক্তব্য, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার পর অ্যাডহকে নিয়োগপ্রাপ্তদের স্থায়ী করা হোক। বিসিএস ক্যাডারদের বঞ্চিত করে যেন অ্যাডহকদের আর সুবিধা দেওয়া না হয়।


মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, প্রমার্জনার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে গত শনিবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্তলাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাডার, নন-ক্যাডার, অ্যাডহক তাঁরা সবাই চিকিৎসক। আমি সব চিকিৎসকেরই অভিভাবক। আমি সকলের সুবিধা-অসুবিধা সমানভাবে দেখতে চাই।’