পাখিদের স্থপতি বাবুই 

মৌলভীবাজারের ভানুগাছে কাটা তালসুতা নিয়ে উড়ছে পুরুষ বাবুই
ছবি: লেখক

কবি রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি কে না জানেন? 

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, 

‘কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, 

আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে

তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।’

বাবুই হাসিয়া কহে, ‘সন্দেহ কি তায়? 

কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়। 

পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা, 

নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।’

এ জীবনে বাবুই পাখি ও তার বাসা কম দেখিনি। তাল ছাড়াও আমার গ্রাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার পুরান বাউশিয়ায় খেজুরগাছে ও রংপুরের রবার্টসনগঞ্জে সুপারিগাছে এ পাখি ও বাসা দেখেছি। রাজশাহীর পদ্মার চরে কালোবুক বাবুই নিয়মিত বাসা করছে লম্বা লম্বা ঘাসের আগায়। ২০১৭ সালে ভারতের নৈনিতাল থেকে জিম করবেট যাওয়ার পথে বৈদ্যুতিক তারে এক প্রজাতির বাবুইয়ের উপনিবেশ বাসা দেখেছিলাম। কিন্তু আফসোস, ছবি তুলতে পারিনি।

যাহোক, বর্ষার পাখির খোঁজে ৩১ আগস্ট গিয়েছিলাম কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায়। অভিযানের শুরুতেই একঝাঁক বাবুইয়ের সঙ্গে দেখা। ২০১৩ সালের এক রোদেলা সকালে মৌলভীবাজারের ভানুগাছ এলাকার তালগাছে কর্মচঞ্চল স্থপতি পুরুষ বাবুইদের বাসা বানাতে দেখেছিলাম। তালপাতায় ঠোঁট চালিয়ে তালসুতা ছেঁড়া থেকে নিপুণ শিল্পীর মতো বাসা বানানো পর্যন্ত সব কর্মকাণ্ডেরই ছবি তুলেছিলাম। সেবারই প্রথম অর্ধসমাপ্ত বাসার ওপর স্ত্রী বাবুইকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রেমিক পুরুষ বাবুইকে নাচতে দেখেছি।

এ দেশে প্রাপ্ত তিন প্রজাতির বাবুইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান দেশি বাবুই, বায়া, বাউই বা বাইল্লা (বায়া উইভার)। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় দেখা মেলে।

দেশের সর্বত্র গ্রাম ও উন্মুক্ত এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা মেলে। ধান, গম ও শস্যদানা পছন্দ। কীটপতঙ্গেও আপত্তি নেই। দলে দলে পাকা ধান ও গমখেতে আক্রমণ করে ফসলের ক্ষতি করে। 

রুচিসম্মত বাসা বানানো পাখিদের মধ্যে এ দেশে বাবুইয়ের স্থান প্রথম। কারণ, তার বাসা বানানোয় রয়েছে নিপুণ শিল্পীর ছাপ। আছে সঠিক ও পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা, সুন্দর প্রবেশপথ, দুর্যোগ বা শত্রুর হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা, একাধিক কুঠুরি, ডিমের ঝুড়ি—সবকিছুই। বাসার নিচের কুঠুরিতে একটু কাদামাটি বা গোবর দিয়ে রাখে, যাতে বাসাটি কিছুটা ভারী হয় ও ঝড়-বাতাসে না ওলটায়। এত বুদ্ধি খাটিয়ে, পরিকল্পনা করে সুনিপুণভাবে বাসা বানায় বলেই তো সে পাখিদের স্থপতি।

স্ত্রী বাবুই বাসা পরীক্ষা করছে, পুরুষ তাকে আকৃষ্ট করতে নাচানাচি করছে
ছবি: লেখক

গ্রীষ্ম প্রজনন ঋতু। এ সময় স্থপতি পুরুষেরা কচি তাল-খেজুর-ধান-ঘাস পাতার শিরার এক পাশে ঠোঁট চালায়। এরপর ওড়ার জন্য খুব জোরে ডানা ঝাপটায়। এতে গতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পত্রফলকের একাংশ ঠোঁটের সঙ্গে কেটে যায়। দু–তিন ফুট লম্বা পত্রফলক ঠোঁটে চেপে যখন পত পত করে ওড়ে, তখন সত্যিই চমৎকার লাগে। এরপর পছন্দের গাছের সরু ডালে সেটা প্যাঁচায়, গিঁট দেয় এবং বাসা বুনতে শুরু করে। সুচালো ঠোঁটের সাহায্যে পাতা ফুটো করে সেলাইয়ের মতো ফোঁড়ের পর ফোঁড় দিয়ে বাসা বোনে। লম্বা টুপি আকারের বাসার অর্ধেকটা তৈরি হয়ে গেলেই উপনিবেশে ঝাঁকে ঝাঁকে স্ত্রী বাবুই হাজির হয়। বরবেশী পুরুষেরা তখন কিচিরমিচির শব্দে প্রেমের গান গেয়ে, ডিগবাজি খেয়ে, বাসা দুলিয়ে প্রেয়সীদের অভ্যর্থনা জানায়। জানায় বিয়ের আহ্বান। স্ত্রীরা একেকটি বাসায় প্রবেশ করে; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তা পরখ করে ও টেনেটুনে বুনন পরীক্ষা করে। এক বাসা থেকে অন্য বাসায় যায়। বাসা পছন্দ হলে সেই বাসার স্থপতিকেই বর হিসেবে বেছে নেয়। এরপর পুরুষ বাসার বাকি কাজ শেষ করে। বাসা তৈরিতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে।

বাসা তৈরি শেষ হতে হতেই স্ত্রী-পুরুষের মিলন হয়। স্ত্রী গড়ে তিনটি ডিম পাড়ে। পুরুষ বহুগামী; স্ত্রী ডিমে তা দেওয়া শুরু করলেই সে বাসা ত্যাগ করে। নতুন বাসা বানানো শুরু করে ও আবার ঘর বাঁধে। আর এভাবেই একটি পুরুষ মৌসুমে দুই, চার বা ততোধিকবার বংশবৃদ্ধি করে। ডিম থেকে ছানা ফুটতে ১০ থেকে ১৩ দিন সময় লাগে। মা ছানাদের কীটপতঙ্গ খাইয়ে বড় করে তোলে। এরপর ধান-গম-শস্যদানা খাওয়া শেখায়। ছানারা ১৫ থেকে ১৯ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।