মানব পাচারবিরোধী পদক্ষেপ জোরদার করেছে বাংলাদেশ: মার্কিন টিআইপি রিপোর্ট
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৫ সালের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে (টিআইপি) বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্তরে স্থান দেওয়া হয়েছে। দেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী অভিবাসনের চাপ-সংশ্লিষ্ট চলমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মানব পাচার মোকাবিলায় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ও টেকসই অগ্রগতির স্বীকৃতি এটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার নির্মূলের সর্বনিম্ন মান পুরোপুরি পূরণ না করলেও আগের তুলনায় এখন উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চলছে। বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী প্রতিবেদনের সময়ের তুলনায় সামগ্রিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশের অবস্থান এ তালিকায় দ্বিতীয় স্তরে।
প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ মানব পাচার রোধে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তসংস্থা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে।
ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ ও সুরক্ষা পরিষেবা বৃদ্ধি, সম্মুখসারির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ‘ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম’ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রশংসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সরকার ১ হাজার ৪৬২ জন পাচারের শিকারকে শনাক্ত করেছে। তাঁদের মধ্যে ১৪৪ জন যৌনকর্মী হিসেবে পাচারের শিকার হয়েছেন এবং ২৮৫ জনকে জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৩৩ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার হয়েছেন। পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে একই সময়ে ১ হাজার ২১০ জন ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের শনাক্ত করার পর সরকার তাঁদের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক, সমাজকল্যাণ, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পরিচালিত কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে এই ভুক্তভোগীদের স্বাস্থ্যসেবা, আইনি সহায়তা ও আশ্রয়ের সুযোগও দেওয়া হচ্ছে।
সরকার সুশীল সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করে ভুক্তভোগীদের সেবার বিষয়ে পুলিশ, অভিবাসন কর্মকর্তা ও শ্রম পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আন্তর্জাতিক মানব পাচারবিরোধী মানদণ্ডের সঙ্গে জাতীয় চর্চাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার মূল পদক্ষেপ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানব পাচার নেটওয়ার্ক তদন্তে ইন্টারপোল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বৈশ্বিক অংশীজনদের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান সহযোগিতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
পাচারবিরোধী পক্ষগুলোকে শক্তিশালী করার এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) মধ্যে সমন্বয় সুদৃঢ় করার জন্য সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
পাচার প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের জন্য এ বছর ৬২১ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫ বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগের বছরের তুলনায় এবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বরাদ্দ বেড়েছে।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের পাচারবিরোধী কমিটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় মুদ্রিত পত্রিকা, রেডিও ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।
এভাবে প্রচারের মাধ্যমে নিরাপদ অভিবাসন, শ্রম অধিকার ও প্রতারণামূলক নিয়োগের ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ১০৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। বিদেশগামী কর্মীদের জন্য প্রস্থানপূর্ব প্রশিক্ষণ সেশন চালু করেছে। এর মধ্যে নারী গৃহকর্মীদের জন্য ৩০ দিনের একটি বিশেষায়িত কোর্সও রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ব্রুনেইয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শ্রমচুক্তি জোরদার করেছে। এ ছাড়া অভিবাসী শ্রমিকদের অতিরিক্ত ফি থেকে বাঁচানোর জন্য নিয়োগকর্তার দেওয়া নিয়োগ মডেল প্রতিষ্ঠা করেছে।
অভিবাসীদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় জাতীয় একটি নীতিও চালু করা হয়েছে। প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গৃহীত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা এটি। পাচার থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরাও এর অন্তর্ভুক্ত, যেন প্রত্যাবর্তনের পর তারা জীবিকার সুযোগ পায়।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসন ও আন্তসীমান্ত সহযোগিতা সহজ করার জন্য ২০১৫ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কাজ অব্যাহত রেখেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে পাচারবিরোধী সমন্বয় জোরদার করার জন্য ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছে।
প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, দেশের চলমান সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা সব ধরনের মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্তরে স্থান পাওয়ার বিষয়টি আইনের শাসন জোরদার, অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও পাচারের শিকার ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতি দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রতিশ্রুতিকে নির্দেশ করে। সরকার মানব পাচার রোধে কাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।