বামন মাছরাঙার খোঁজে

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর বন বিটে বামন মাছরাঙা
ছবি: লেখক

বিপন্ন পাখিটিকে বহুবার খুঁজেছি রাঙামাটির কাপ্তাই, হবিগঞ্জের সাতছড়ি ও মৌলভীবাজারের আদমপুর গহিন বনের ছড়ার ধারে। কিন্তু অতি বিরল পুঁচকে পাখিটির সন্ধান পাইনি কখনোই। তবে ২০১৩ সালে বন্য প্রাণিপ্রেমী ও আলোকচিত্রী প্রয়াত তানিয়া খানের সঙ্গে গিয়ে আদমপুরে পাখিটির একটি পরিত্যক্ত বাসা দেখেছিলাম। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত বহুবার ওসব স্থানে পাখিটিকে খুঁজেছি; কিন্তু ফলাফল শূন্য।

মাঝে করোনার দুই বছরে বন-জঙ্গলে ঘোরাঘুরি প্রায় বন্ধই ছিল। এ বছরের শুরুতে প্রজনন মৌসুমে পাখিটিকে খোঁজার পরিকল্পনা করেছিলাম। সেই লক্ষ্যে মাঝে একবার আদমপুরে ওর প্রজননের সম্ভাব্য স্থানগুলো দেখেও এসেছিলাম।

কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততার কারণে জুলাই থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে যেতে পারিনি। ইতিমধ্যে বেশ কজন পক্ষী আলোকচিত্রী পাখিটির ছবি তুলেছে। তাই আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ওর খোঁজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু মৌলভীবাজারের পক্ষী আলোকচিত্রী খোকন থৌনাজাম জানালেন, আদমপুরে বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া সম্প্রতি ঢোকা যাচ্ছে না। কাজেই ‘পাখির প্রজনন প্রতিবেশ গবেষণা’কাজের জন্য প্রধান বন সংরক্ষক থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে ২৬ আগস্ট সকালে আদমপুরে প্রবেশ করলাম।

আগের দিন খোকন বিরল পাখিটির প্রজননের সম্ভাব্য স্থানগুলোর অন্তত তিনটিতে পাখিটিকে দেখেছিলেন। কিন্তু সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেই স্থানগুলোতে পাখিটিকে দেখা গেল না। দুপুর পৌনে ১২টায় প্রধান স্থানের দুই পাশে দুজন চুপচাপ বসে রইলাম।

ঠিক ১২টা ২০ মিনিটে খোকনের সংকেত পেয়ে শব্দহীনভাবে পাখিটির পাশে গিয়ে গাছের গুঁড়ির ওপর মূর্তির মতো বসলাম। আর তখনই ঝোপের আড়ালে অতি সরু ডালে বসা পাখিটি নজরে এল। প্রথম দেখায় ওটির লাল-কমলা-নীল-বেগুনি রঙে চোখ ধাঁধিয়ে গেল! খোকনের ক্যামেরার শাটারে ক্লিকের বন্যা বয়ে গেলেও আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম পাখিটির দিকে! খোকনের ফিসফিসানিতে ক্যামেরার শাটারে আমার ডান হাতের তর্জনীর চাপ পড়ল। পাখিটি উড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত ১ মিনিট ৬ সেকেন্ড ধরে থেমে থেমে ক্লিক করেই গেলাম।

বিপন্ন ওই খুদে পাখির দেহের রং সত্যিই চোখধাঁধানো! একনজরে দেখলাম, পাখিটির মাথা বেগুনি আভাযুক্ত গাঢ় কমলা। কপাল, গাল ও ঘাড় কমলা। কপাল ও ঘাড়ের পাশে নীল দাগ। ঘাড়ের নীলের নিচে সাদা দাগ। ডানা ও পিঠ কালচে-নীল ও তাতে থাকে বেগুনি আভা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে এক হলেও পুরুষ খানিকটা বড়। দৈর্ঘ্য গড়ে মাত্র ১৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১৪ থেকে ২১ গ্রাম।

এগুলো বংশবৃদ্ধির জন্য বর্ষাকালে এ দেশে আসে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের গহিনের ছড়া ও জলাশয়ের পাশে ছায়াঘেরা স্থানে একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। তবে অনিয়মিতভাবে আসে বলে সব সময় চোখে পড়ে না। পানির ওপর ঝুলে থাকা লতাগুল্মের আড়ালে থাকা ডাল বা পাথরের ওপরে লুকিয়ে বসে থাকে। হঠাৎ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, ব্যাঙাচি, গিরগিটি বা কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী ধরে খায়। পানির সামান্য ওপর দিয়ে অতি দ্রুত উড়ে যায়। ওড়ার সময় ‘চিট–চিট...’ শব্দে ডাকে।

এই পাখিগুলো এ দেশে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রজনন করে। পাহাড়ি ছড়ার খাড়া পাড়ে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়, যা ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। স্ত্রী পাখি পাঁচ থেকে সাতটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। উভয়ে পালা করে ১৭ থেকে ১৮ দিন ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায়। এরপর মা–বাবা মিলেমিশে ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা ১৮ থেকে ২০ দিনে উড়তে শেখে। এগুলোর আয়ুষ্কাল চার থেকে পাঁচ বছর।

এক যুগ সন্ধানের পর খুঁজে পাওয়া বিপন্ন পাখিটির নাম বামন মাছরাঙা বা বুনো মাছরাঙা। ওরা এ দেশের ক্ষুদ্রতম মাছরাঙা। ইংরেজি নাম ওরিয়েন্টাল ডুয়ার্ফ কিংফিশার, ব্ল্যাক-ব্যাকড কিংফিশার বা থ্রি-টোড কিংফিশার। অ্যালসিডিনিডি গোত্রের মাছরাঙাটির বৈজ্ঞানিক নাম Ceyx erithaca। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাখিটির বিস্তৃতি। তবে দিনে দিনে এ দেশে আবাস এলাকা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় পাখিটি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কাজেই প্রকৃতির সৌন্দর্য বামন মাছরাঙাকে রক্ষার পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।