ঢাকার শেখেরটেকে সরকারি কার্যালয়কে হোস্টেল বানিয়ে ভাড়া আদায়

আটটি থানা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের জন্য রাজধানীর শেখেরটেকে একটি ভবনের পাঁচতলা ভাড়া নিয়েছে বিবিএস। তবে সেখানে কোনো কার্যক্রম নেই।

রাজধানীর শেখেরটেকের এই বাড়িতে রয়েছে বিবিএসের আটটি থানা কার্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার একটি ভবনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আটটি থানা কার্যালয় রয়েছে। কাগজে–কলমে থানা পরিসংখ্যান কার্যালয় বলা হলেও সেখানে বিবিএসের কোনো কার্যক্রম নেই; বরং কার্যালয়গুলো ব্যবহার করা হচ্ছে হোস্টেল হিসেবে। বিবিএসের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঢাকায় এলে সেখানে থাকেন। এ জন্য তাঁদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। অন্যদিকে থানা কার্যালয়ের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য খরচের কথা বলে সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দের টাকাও নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বিবিএসের অনুমোদিত থানা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের সংখ্যা ৩৯। এর মধ্যে ৩০টি কার্যালয়ের অবস্থান আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের সদর দপ্তরের তৃতীয় তলায়। একটি কার্যালয় ডেমরায়। বাকি আটটি কার্যালয়ের জন্য ২০১৮ সালে শেখেরটেকের ১১ নম্বর সড়কে ১০ নম্বর বাড়ির পাঁচটি তলা ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

ওই ভবনের প্রতিটি তলায় দুটি ইউনিট। প্রতি ইউনিটে দুটি করে কক্ষ। ভবনের দোতলায় দেখা যায়, সেখানে বিবিএসের থানা কার্যালয়ের কোনো কার্যক্রম নেই। একটি কার্যালয় চালাতে টেবিল, চেয়ার, কাগজপত্রসহ যেসব জিনিসের দরকার হয়, সেসবের কিছুই সেখানে নেই। আছে শুধু কর্মকর্তাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রতি কক্ষে খাট, মশারি, সোফাসেট ও আলমারি দেখা গেল।

বিবিএসের এই আটটি থানা কার্যালয় কেমন চলছে, তা দেখতে প্রথম আলোর এ প্রতিবেদক ২৩ সেপ্টেম্বর ওই ভবনে যান। এটি মূলত একটি আবাসিক ভবন। সেখানে বিবিএসের কোনো সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। সাততলা ভবনের পাঁচটি তলা ভাড়া নিয়েছে বিবিএস। অন্য দুটির একটিতে বাড়ির মালিক, আরেকটিতে অন্য ভাড়াটে থাকেন। ভেতরে যেতে চাইলে দারোয়ান বাধা দেন। বেশ কিছু সময় পর বাড়ির মালিকের স্ত্রী আনোয়ারা পারভীন নিচে নেমে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা এটি হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রশিক্ষণ থাকলে কর্মকর্তারা এখানে এসে থাকেন। অফিসের কাজে ব্যবহার হচ্ছে না।

সাততলা ভবনটির মালিক সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আরশাদ হোসেন। তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবিএসের উপমহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ওই বছরই ভবনের পাঁচটি তলা ভাড়া নেয় বিবিএস। পরে তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন। ২০২১ সালের অক্টোবরে অবসরে যান আরশাদ হোসেন। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা পারভীন নিজেও এ প্রতিবেদককে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বিবিএসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশিক্ষণের উদ্দেশে ঢাকায় এলে এখানে থাকেন। প্রতি রাতের জন্য ২০০ টাকা করে রাখা হয়। এ টাকা তিনি নিজে আদায় করে পরে সদর দপ্তরে জমা দেন।
ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ নকিব

ওই ভবনের প্রতিটি তলায় দুটি ইউনিট। প্রতি ইউনিটে দুটি করে কক্ষ। ভবনের দোতলায় দেখা যায়, সেখানে বিবিএসের থানা কার্যালয়ের কোনো কার্যক্রম নেই। একটি কার্যালয় চালাতে টেবিল, চেয়ার, কাগজপত্রসহ যেসব জিনিসের দরকার হয়, সেসবের কিছুই সেখানে নেই। আছে শুধু কর্মকর্তাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রতি কক্ষে খাট, মশারি, সোফাসেট ও আলমারি দেখা গেল।

থানা পরিসংখ্যান কার্যালয়কে হোস্টেল বানিয়ে দেওয়া ভাড়ার টাকা তুলতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন তত্ত্বাবধায়ককে। ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ নকিব প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বিবিএসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশিক্ষণের উদ্দেশে ঢাকায় এলে এখানে থাকেন। প্রতি রাতের জন্য ২০০ টাকা করে রাখা হয়। এ টাকা তিনি নিজে আদায় করে পরে সদর দপ্তরে জমা দেন। নকিব বলেন, সব সময় প্রশিক্ষণ থাকে না। মাসে একটি–দুটি থাকে। বেশির ভাগ সময় কক্ষ খালি থাকে।

সরকারের একটি সংস্থার কর্মকর্তাদের এ ধরনের ব্যবসা করার সুযোগ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুরক্ষা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এমনটা চলতেও পারে না। সরকারের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিজ বাড়িতে অফিসের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে হোস্টেল বানানোর মানে হচ্ছে এটি বহুস্তর বিশিষ্ট অনিয়ম। এটা দ্রুত বন্ধ করা উচিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

থানা কার্যালয়ের পেছনে সরকারের যত খরচ

থানা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের কাজ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট থানার জনসংখ্যা, জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, তালাক ও প্রতিবন্ধীদের তথ্য সংগ্রহ করা। উৎপাদিত ফসলের তথ্য সংগ্রহ করাও এই কার্যালয়ের দায়িত্ব। বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও কৃষি মজুরির হার সংগ্রহ করে বিবিএসের সদর দপ্তরে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।

চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শেখেরটেকে অবস্থিত আটটি থানা কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ মাসে সরকারের খরচ হয় ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বছরে শুধু ভাড়া বাবদ খরচ হয় ৩৩ লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া প্রতিটি থানা কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিল, গাড়ির তেল, গাড়ি মেরামত, ভ্রমণ ব্যয়, পোশাক কেনা, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য খাতে প্রতি অর্থবছরে মাসিক বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। গড়ে দুই লাখ টাকা করে হিসাব করলে বছরে খরচ হয় আরও ২৪ লাখ টাকা। প্রায় পাঁচ বছর ধরে সরকারি তহবিল থেকে এই টাকা জোগান দেওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে কোনো কার্যালয়ই নেই।

বিবিএসের মহাপরিচালক মতিয়ার রহমানের দাবি, থানা কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের তেমন কাজ থাকে না। তাঁদের কাজ মাঠে। সে জন্য শেখেরটেকে অবস্থিত ওই ভবনকে হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকে যাঁরা আসেন, তাঁরা থাকতে পারেন।

কিন্তু সেখান থেকে ভাড়া ওঠানো হয়, আবার সরকারের কাছ থেকেও বরাদ্দের টাকা নেওয়া হয় কেন—এমন প্রশ্নে মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধরে ধরে এত অনিয়মের বিষয় জানা ছিল না। এ ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে তা মানব না। আমি পুরো বিষয়টি দেখব।’

বহুস্তর বিশিষ্ট অনিয়ম

একাধিক থানা পরিসংখ্যানবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ভাড়া করা থানা কার্যালয়ে যেতে চান; কিন্তু নানা অজুহাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেতে দেন না। কারণ, তাঁরা চান থানা কার্যালয়ের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রধান কার্যালয়ের মধ্যেই থাকুক এবং সেখানেই খরচ হোক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিএসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আটটি থানা কার্যালয়ে প্রতিবছর বাজেটে দেওয়া বরাদ্দের টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, তার তদন্ত হওয়া উচিত। আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের সদর দপ্তরের ৩০টি থানায় বরাদ্দের টাকা কোথায় খরচ হয়েছে; তা–ও খতিয়ে দেখা উচিত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের একটি সংস্থার কর্মকর্তাদের এ ধরনের ব্যবসা করার সুযোগ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুরক্ষা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এমনটা চলতেও পারে না। সরকারের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিজ বাড়িতে অফিসের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে হোস্টেল বানানোর মানে হচ্ছে এটি বহুস্তর বিশিষ্ট অনিয়ম। এটা দ্রুত বন্ধ করা উচিত।