বিমার দায় কে নেবে

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনকালে পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতি হলে এর আর্থিক দায় কে নেবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ব্যাচের পারমাণবিক জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) রাশিয়া থেকে আসছে আগামী অক্টোবর। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এ জ্বালানি নেওয়া হবে পাবনার ঈশ্বরদীতে প্রকল্প এলাকায়। তবে জ্বালানি পরিবহনের সময় কোনো ঘটনা ঘটলে, এর আর্থিক দায় কে নেবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

ইতিমধ্যে পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির বিমা করতে গত এপ্রিল মাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

আইন অনুযায়ী, পারমাণবিক ঘটনাজনিত (ইনসিডেন্ট) ক্ষতির আর্থিক দায় মেটাতে বিমার ব্যবস্থা করবে প্রকল্পের অপারেটর ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)’। তবে পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে থাকা এ কোম্পানি বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখনো উৎপাদনে আসেনি। তাদের আয় শুরু হয়নি। প্রতিবছর প্রিমিয়ামের টাকা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। সার্বিক দিক বিবেচনায় পারমাণবিক ঘটনাজনিত বিমা করার মতো অবস্থায় তারা নেই। সরকার এই দায়িত্ব নিতে পারে।

রূপপুরের মতো এত বড় প্রকল্পে পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির বিমা করার অভিজ্ঞতা দেশের কারও মধ্যে দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের সহযোগিতা নিতে হবে।
মাহমুদ হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী, পরমাণু শক্তি কমিশন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসানকে দেওয়া চিঠিতে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অশোক কুমার পাল বলেন, বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একটি প্রযুক্তিঘন স্থাপনার বিমা করার অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানের নেই। তবে তিনি মনে করেন, বিমাকরণের ক্ষেত্রে সরকারের মালিকানাধীন বিমা প্রতিষ্ঠানে বিমা করা যৌক্তিক হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বর্তমানে বিমা করলে প্রতিবছর প্রিমিয়াম হিসেবে যে ব্যয় হবে, তা প্রকল্পের বিনিয়োগ খরচ হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে বিদ্যুতের ট্যারিফে প্রভাব পড়বে। এমন বাস্তবতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ঢাকা থেকে প্রকল্প এলাকায় পরিবহন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সময় যেকোনো পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির বিমার খরচ অপারেটরের পরিবর্তে সরকার বহন
করতে পারে।

রূপপুরের মতো এত বড় প্রকল্পে পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির বিমা করার অভিজ্ঞতা দেশের কারও মধ্যে দেখা যায় না উল্লেখ করে পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান প্রকৌশলী মাহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের সহযোগিতা নিতে হবে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, প্রতিটি পারমাণবিক ঘটনার বিষয়ে দায়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে ৩০ কোটি স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর)। এসডিআর হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের রিজার্ভ মুদ্রা। ১ এসডিআর সমান ১ দশমিক ৩৪৭৮ ডলার ছিল গতকাল। সেই হিসেবে প্রতিটি ঘটনায় দায়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা)। তবে প্রতিবছর কত কিস্তিতে প্রিমিয়াম দিতে হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। কত শতাংশ হারে প্রিমিয়াম দিতে হবে, তা-ও চূড়ান্ত হয়নি।

পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির বিমা কে করবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে একাধিকবার আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। সাধারণ বিমা করপোরেশন বলছে, এই বিমা করার সক্ষমতা তাদের আছে। বিষয়টি এরই মধ্যে পরমাণু শক্তি কমিশনকে জানানো হয়েছে। সাধারণ বিমার কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকে মনে করেন, দেশে এত বড় বিমা করার মতো অবস্থা কারও নেই। এটি ভুল ধারণা। রূপপুরের মতো বড় প্রকল্পে বিমা করার মাধ্যমে দেশের বিমা খাত সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। এতে মানুষের আস্থা বাড়বে।

এ বিষয়ে সাধারণ বিমার মহাব্যবস্থাপক ওয়াসিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকালীন বিমা তাঁরাই করেছেন। বিশ্বের বড় বড় বিমা কোম্পানির সঙ্গে তাঁদের পুনর্বিমা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকালীন ঝুঁকির বিমাও সাধারণ বিমা করপোরেশনে করেছে প্রকল্প অপারেটর এনপিসিবিএল।

২০১৯ সালে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের ওই বিমা হয়েছিল। সে অনুযায়ী, চার কিস্তিতে প্রায় ৫ কোটি ডলার প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হবে সাধারণ বিমা করপোরেশনকে।

এদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আকাশপথে পারমাণবিক জ্বালানি এসে নামবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জ্বালানি নিয়ে যাবেন প্রকল্প এলাকায়। এ সময় কোনো ক্ষতি হলে আইন অনুযায়ী এর দায়ভার অপারেটরের। একই সঙ্গে বিমার দায়িত্বও তার। তবে চাইলে সরকার সে দায়ভার নিতে পারে। কারণ, প্রকল্পের অপারেটর এনপিসিবিএল সরকারের একটি কোম্পানি। সরকারের কাছে সেই আর্থিক নিশ্চয়তাপত্র চেয়েছে পরমাণু শক্তি কমিশন।

পরমাণু শক্তি কমিশনের চিঠির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসচিব জিয়াউল হাসান মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পরমাণু শক্তি কমিশনের চিঠি তাঁরা পেয়েছেন।

পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির বিমার দায় অপারেটরের পরিবর্তে সরকার নেবে কি না, তা নিয়ে বৈঠক হবে। এ ছাড়া কোথায় বিমা করা হবে, বৈঠকে তা নিয়েও আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, যেকোনো পারমাণবিক ঘটনাজনিত ক্ষতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিতে পারে। তবে বিমা করতে হলে দেশীয় কোনো বিমা কোম্পানিতেই করতে হবে।