পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী ও সারওয়ার আলী: কেমন আছেন তিন অগ্রজ

পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিন তরুণ নেতা ও কর্মী পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী ও সারওয়ার আলী। বয়সে অগ্রজ হলেও সে সময় তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন মতিউর রহমান। এই তিনজনকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সারওয়ার আলী ও রেজা আলী

আমার তিন অগ্রজ ও বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে পঙ্কজ ভট্টাচার্য—আমাদের পঙ্কজদার বয়স ৮৪ বছর। সম্প্রতি তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। কয়েকবারই হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কোভিড থেকে শুরু করে শ্বাস–প্রশ্বাসজনিত সমস্যা, এমনকি অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে বড় কোনো সমস্যা না হলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। চিকিৎসা চলাকালে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল ও আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়েছি। খোঁজখবর নিতে বাসায় যাই। তিনি ভালো আছেন এখন।

অগ্রজ রেজা আলী—আমাদের রেজা ভাইয়ের বয়স ৮২ বছর। সম্প্রতি তিনি বেশ কয়েকবার হৃদ্‌যন্ত্রের অসুখে ভুগেছেন। এর বাইরেও হাঁটু–কোমরে সমস্যাসহ নানা অসুস্থতায় ঢাকা, সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। রেজা ভাইয়ের চিকিৎসা বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গেও বেশ কয়েকবার চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি। রেজা ভাই ও ভাবির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এখন চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর আছেন।

আরেক অগ্রজ ডা. সারওয়ার আলী—আমাদের সারওয়ার ভাই পূর্ণ করবেন ৮১ বছর। সম্প্রতি তিনিও কমবেশি নানা অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তবে তুলনামূলকভাবে বেশ ভালোই ছিলেন। যদিও কিছুদিন হলো বড় অসুখে আক্রান্ত হন। কদিন আগে চিকিৎসা করাতে ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচি শহরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁকে অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছে। কোচিতে যাওয়ার আগে তাঁর উত্তরার বাসায় দেখা করতে গেলে অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। তিনি এখন প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এখনো নিয়মিত ভালো–মন্দ খোঁজখবর আদান–প্রদান হয় তাঁর সঙ্গে।

দুই

এই যে আমার তিন অগ্রজ—পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী ও সারওয়ার আলী—তাঁরা আমার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও আমাদের সময়ে নানা উত্থান-পতন–অভ্যুদয়ের মধ্যেও ষাট বছর ধরে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় আছে। তিনজনকেই আমি চিনি–জানি সেই ১৯৬২ সাল থেকে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এই তিন তরুণ কর্মী ও নেতা অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। গোপন–প্রকাশ্য ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতিমূলক কাজ বা রাজপথের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার ভূমিকায় তাঁরা তিনজন ছিলেন সামনের সারিতে।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য
ফাইল ছবি

পঙ্কজ ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। রেজা আলী ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। আর সারওয়ার আলী পড়তেন মেডিকেল কলেজে। ১৯৬৩ সালে প্রাদেশিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও সারওয়ার আলী ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি হয়েছিলেন। রেজা আলী হয়েছিলেন সহকারী সাধারণ সম্পাদক। একই সঙ্গে সারওয়ার আলী সে সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হন।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য চট্টগ্রাম থেকে এসে উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। রেজা আলীর বাসা ছিল তোপখানা রোডে। সারওয়ার আলীর বাসা নয়াপল্টনে হলেও থাকতেন মেডিকেল কলেজের হলে। ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রনেতারা আত্মগোপনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এসে আশ্রয় নিতেন। তখন পুলিশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ভেতরে ঢুকতে পারত না। ফলে এই হল–আবাসগুলো খুব নিরাপদ ছিল ছাত্রনেতা ও কর্মীদের জন্য।

সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ও বৃহত্তর গণ–আন্দোলনে তাঁরা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের এই যুক্ততা ও সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের পেছনে প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। আমাদের সবার জন্যই তিনি হয়ে উঠেছিলেন নেতা। তাঁদের সঙ্গে আরও একটি নাম যুক্ত হবে—সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, যিনি ২০০৮ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শুধু ষাটের দশকই নয়, আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মানুষগুলোর বহুমুখী ভূমিকার সঙ্গে আমরাও নানাভাবে যুক্ত ছিলাম।

বয়সের পার্থক্য হলেও সেই ’৬২ সাল থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রকাশ্য–গোপন বহুমুখী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের সঙ্গে আমরাও যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিগত দশকগুলো ধরেই ওই তিন অগ্রজের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত আছে। বিগত ষাটের দশকের নানা পরিবর্তনের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ততা এবং সময়ের ব্যবধান বা কোনো কোনো সময়ে সাময়িক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলেও ঘুরেফিরে আমাদের চলমান জীবনের যাত্রাপথে বন্ধুত্বের কোনো বিরতি হয়নি। নানা কাজের চাপ, সুবিধা–অসুবিধা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সময় পরপর আমরা ঠিকই একত্র হতাম। অতীত–বর্তমান নিয়ে স্মৃতিচারণা করতাম সেই আড্ডাগুলোতে। নানামুখী আলোচনায় সে সময়গুলো কেটে যেত অনেক আনন্দে। এমনকি কোভিডের সময়েও আমরা একবার রেজা ভাইয়ের বসুন্ধরার বাসায় দীর্ঘ সময় জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিলাম। সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত বন্ধু আবুল হাসনাতও। আড্ডায় উঠে এসেছিল আমাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুর সেই উত্তাল দিনগুলোতে নানামুখী কাজ ও ঘটনার মধ্য দিয়ে সঞ্চিত বহু অভিজ্ঞতার কথা। সাম্প্রতিক দেশের পরিবর্তন, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং হতাশা–দুঃখ–বেদনার অনেক কথাও হয়েছিল সেদিন। বিগত মাসগুলোতে বারবার কথা বলেছি এমন আরেকটি বৈঠক করার সময় নিয়ে। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। সেটা আর সম্ভব কি?

তিন

পঙ্কজ ভট্টাচার্য চট্টগ্রাম থেকে এসে উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। রেজা আলীর বাসা ছিল তোপখানা রোডে। সারওয়ার আলীর বাসা নয়াপল্টনে হলেও থাকতেন মেডিকেল কলেজের হলে। ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রনেতারা আত্মগোপনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এসে আশ্রয় নিতেন। তখন পুলিশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ভেতরে ঢুকতে পারত না। ফলে এই হল–আবাসগুলো খুব নিরাপদ ছিল ছাত্রনেতা ও কর্মীদের জন্য।

সুদর্শন পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী ও তুখোড় বক্তা। ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হিসেবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। ছাত্র আন্দোলনে যুক্ততার জন্য একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। প্রথম গ্রেপ্তার হন ১৯৬৪ সালে। চতুর্থবার ১৯৬৭ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলায়। রাজবন্দী হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম–কুমিল্লার বিভিন্ন কারাগারে তাঁর দিন কেটেছে। সে সময় কারাবন্দী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ কমিউনিস্ট বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে থেকে তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা আরও গভীর হয়েছে। আমার মনে আছে, তৃতীয়বার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি সরাসরি আমাদের পুরান ঢাকার বংশালের বাসায় চলে এসেছিলেন। বলতে গেলে আমাদের পারিবারিক সদস্যই হয়ে উঠেছিলেন পঙ্কজদা। আমার মা তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। ভাইবোনদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পঙ্কজদার। আজও সেসব দিনের কথা তাঁঁরা স্মরণ করেন।

সারওয়ার আলী
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পঙ্কজদা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হন। এই পদ নিতে তাঁর বেশ আপত্তি ছিল সে সময়।

মজার বিষয় হলো, ফেরার পথে রেজা ভাই পুলিশের দলসহ তাঁদের সেই তোপখানা রোডের বাসায় যেতেন। পরিবারের বড় সন্তান, বাসায় গিয়ে ভালো খাওয়াদাওয়া করতেন। তারপর পুলিশ দলের সঙ্গে আবার জেলে ফিরে যেতেন। একবার তো দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে পুলিশ বাহিনী নিয়ে গুলিস্তান হলে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিলেন। সিনেমা শেষে বিকেলে যথারীতি জেলে ফিরে গেলেন।

রেজা আলী কোনো দিন ঘরোয়া সভা বা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেননি। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের সময়। বেশ কয়েক বছর জেলে ছিলেন। সে সময় তিন মাস পরপর বিনা বিচারে আটক রাজবন্দীদের হাইকোর্টে এসে একজন বিচারকের সামনে আটকাদেশ পর্যালোচনার জন্য হাজিরা দিতে হতো। রেজা ভাইকেও আসতে হতো। তাঁর সঙ্গে পুলিশের গাড়িতে তিন–চারজনের একটি দল আসত। রেজা ভাইকে হাইকোর্টে নিয়ে যেত তারা।

মজার বিষয় হলো, ফেরার পথে রেজা ভাই পুলিশের দলসহ তাঁদের সেই তোপখানা রোডের বাসায় যেতেন। পরিবারের বড় সন্তান, বাসায় গিয়ে ভালো খাওয়াদাওয়া করতেন। তারপর পুলিশ দলের সঙ্গে আবার জেলে ফিরে যেতেন। একবার তো দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে পুলিশ বাহিনী নিয়ে গুলিস্তান হলে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিলেন। সিনেমা শেষে বিকেলে যথারীতি জেলে ফিরে গেলেন। শুধু তা–ই নয়, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে–পরে আত্মগোপনে থাকাকালেও রেজা ভাই কখনো–সখনো তোপখানা রোডে নিজের বাড়িতে এসে থাকতেন। তখন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ করতাম। নানা ধরনের কাজে সাহায্য করেছি তাঁকে।

বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা গ্রেপ্তারের আশঙ্কা থাকলেও সারওয়ার ভাইকে কখনো গ্রেপ্তার বা জেলে যেতে হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সারওয়ার ভাই, বন্ধু ডা. ওয়াজেদ, হাসনাতসহ চলে গিয়েছিলাম আমার নানাবাড়ি কাপাসিয়ায়। সেখান থেকে রায়পুর হয়ে (নরসিংদী) তারপর আগরতলায় যাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টা আমরা একসঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করেছি।

চার

সেই ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের অধিক যুক্ততার কারণে পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী বা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক স্বাভাবিকভাবে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পরীক্ষায়ও অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমার মনে পড়ে, ১৯৬৬ সালে যখন আমি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিই, একই সময়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী ও সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁদেরও সিট পড়েছিল কার্জন হলে। একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিলাম আমরা।

আমাদের মধ্যে যাঁরা ভবিষ্যতেও রাজনীতি করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, ১৯৬৭ সালে তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছাত্র ইউনিয়নের কাজ শেষ করে ন্যাপে (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) যোগ দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরীসহ আরও অনেকে ছিলেন।

সে সময় রাজনীতির পাশাপাশি সারওয়ার আলী ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত হন। আজও তিনি ছায়ানটের কার্যকরী সভাপতি। অবশ্য তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন পুরোটা সময়। আর আশির দশকে আফ্রো–এশীয় গণসংহতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন। ১৯৬৮ সালে যোগ দিয়েছিলেন রেনেটা (ফাইজার) ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। পরে ছয়–সাত বছর এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বর্তমানে চেয়ারম্যান পদে আছেন। এ রকম একটি বড় দায়িত্ব পালন করেও সারওয়ার ভাই রাজনীতিসহ নানা সংগঠনে কাজ করেছেন সারা জীবন।

ভুল না হলে ১৯৬৭ সালে রেজা আলী রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা করবেন বলে মনস্থির করেন। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি প্রথমে বিটপীকে একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৯ সালে বিটপীকে অ্যাডভার্টাইজিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন এবং সফল হন। বিটপী নামটি দিয়েছিলেন রেজা আলীর মা সারা আলী। সে সময় বিটপীর প্রথম প্যাডটা আমিই ছাপিয়ে দিয়েছিলাম তৎকালীন জনসন রোডের অ্যাসোসিয়েট প্রেস থেকে।

রেজা আলী
ফাইল ছবি

রেজা ভাইয়ের বিটপী অ্যাড এজেন্সি আরও বড় হতে থাকে। আশির দশকে তিনি ধীরে ধীরে পোশাকশিল্পের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়লেন। সেখানেও সফল হলেন। সরাসরি না হলেও সত্তর–আশির দশকে ঠিকই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। আসলে সেই ষাটের দশকের দিনগুলোকে তিনি পুরোপুরি ভুলতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত রেজা ভাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার কসবা থেকে তাঁর পিতা তোফাজ্জল আলী প্রথমে সংসদ সদস্য, পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু রেজা ভাই ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলায় বড় মৎস্য খামার গড়ে তোলেন। সেখানে বেশ কিছু সামাজিক, রাজনীতিক কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ–৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হন। রাজনীতিবিদ বা সংসদ সদস্য হিসেবে রেজা ভাই সততার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অন্য অনেক সংসদ সদস্য বা রাজনীতিবিদদের মতো তাঁর সম্পর্কে কখনো কোনো দুর্নামের কথা আমরা শুনিনি। তবু পরবর্তী দুই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি তিনি। ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত হলেও শেষ সময়ে কীভাবে যেন সেটি বদলে যায়।

পাঁচ

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও পঙ্কজদা, রেজা ভাই ও সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা একত্রে বহু কিছু করেছি। এভাবেই আমরা—ষাট থেকে আশি বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা-কর্মীরা ন্যাপসহ কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন কার্যক্রমে আরও গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়ি। তবে আমি নব্বই দশকের শুরুতেই সরাসরি রাজনীতি ছেড়ে পুরোপুরি সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে পড়ি। তাই সে সময় আমার অগ্রজদের রাজনীতিসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে সবকিছু জানতাম—এমন দাবি করতে পারব না।

পঙ্কজদা প্রায় দুই দশক নানা তর্ক–দ্বন্দ্বের মধ্যে ন্যাপের নানামুখী দায়িত্ব পালনের পর যে আশা নিয়ে গণফোরামে যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে কিছু হয়নি। পরে নতুন করে ঐক্য ন্যাপ গঠন করেন। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নানাভাবে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। রাজনীতিতে গণতন্ত্র বা দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিপদ–সংকটকালে তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ আমরা শুনেছি। মন্ত্রিত্ব বা অন্য কোনো প্রলোভন তাকে টলাতে পারেনি।

পঙ্কজদা ইতিমধ্যে তাঁর আত্মজীবনী সেই সব দিন–এর কাজ শেষ করেছেন। শিগগিরই সেটি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হবে। তিনি আশা করেন, আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

রেজা ভাইও সুস্থ হয়ে আবার তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে সব পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করবেন, সেটা আমরা চাই। গত সপ্তাহে ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। গত রোববার বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা নিতে সিঙ্গাপুর গেছেন। সেখান থেকে তিনি ভালো হয়ে ফিরবেন, সেটাই চাই।

সারওয়ার ভাই নিশ্চয়ই চিকিৎসা–পরবর্তী বিশ্রাম শেষে আবার ছায়ানট বা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মতো অন্যান্য সংগঠনে সাধ্যমতো ভূমিকা রাখবেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনী পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ (২০১০) প্রকাশ করেছেন। এই বইয়ের আরেকটি সংস্করণ বের হওয়ার সময় হয়েছে। সেটা নিয়ে তিনি কাজ শুরু করবেন আশা করি। তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন, এটাই আমাদের কামনা।

আমার এই তিন অগ্রজ বন্ধু—পঙ্কজদা, রেজা ভাই ও সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে ষাট বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কথা সব সময় মনে করি। দেশের পতন–অভ্যুদয়–বন্ধুর পথে রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং আমাদের জীবনের অতীত ও বর্তমান কত কিছুর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছেন তাঁরা! সেই সব কথা, সব স্মৃতি থেকে যাবে আমাদের মনের ভেতরে, একান্তভাবে।