হাতিরঝিলসহ তিন প্রকল্প পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃতিভিত্তিক ১৪টি সেরা প্রকল্পের তালিকা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা সিডিকেএন। এতে দেশের তিনটি অবকাঠামো রয়েছে।

ঢাকার হাতিরঝিল
ফাইল ছবি

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৃতিনির্ভর সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে। দরিদ্র্য বা উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সীমিত অর্থনৈতিক সামর্থ্য নিয়েও বসে নেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।

ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের প্রকৃতিবান্ধব কিছু প্রকল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃতিভিত্তিক ১৪টি সেরা প্রকল্পের তালিকা প্রকাশ করেছে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নলেজ নেটওয়ার্ক (সিডিকেএন)। এতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের তিনটি প্রকল্প।

রাজধানীর হাতিরঝিল, রংপুরের কারুপল্লী ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের মাধুরছড়াকে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ সিডিকেএনের তালিকায় স্থান পেয়েছে। গত নভেম্বরে প্রকাশিত ‘দক্ষিণ এশিয়ার শহরে জলবায়ুসহিষ্ণু ও প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের আরও চারটি উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের প্রকৃতি সুরক্ষার শর্ত মেনে নির্মাণ করা অবকাঠামোকে ওই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের ৯টি এবং নেপালের ২টি প্রকল্প সিডিকেএনের এ তালিকায় স্থান পেয়েছে।

আইইউসিএন, বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক রাকিবুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, সিডিকেএনের তালিকায় বাংলাদেশের তিনটি প্রকল্প স্থান পেয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় দ্বীপের উপকূলে সামুদ্রিক শৈবাল ও ঝিনুকের আস্তরণে তৈরি বাঁধ, ঢাকার শহরের ছাদে গড়ে ওঠা বাগান ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোর বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ করেছে।

রোহিঙ্গাশিবিরে পরিবেশ রক্ষা

প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। সেখানে পর্যটননির্ভর নানা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া গড়ে উঠছে বিশেষ শিল্প এলাকা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো ভারী অবকাঠামো। কিন্তু স্থানীয় মানুষের মধ্যে দরিদ্র্যের হার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। দেশে গড়ে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। টেকনাফ ও উখিয়ায় সেটা ৩০ ও ৪০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, উখিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর, আর ৮৫ শতাংশ মানুষ জেলে হিসেবে কাজ করে। এ এলাকায় কুতুপালংসহ ৩৪টি আশ্রয়শিবির রয়েছে, যেখানে ৮ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করে। আশ্রয়শিবির করতে গিয়ে উখিয়ার সবচেয়ে বড় পানির উৎস মাধুরছড়া ভরাট ও দূষিত হয়।

টেকনাফ ও উখিয়ার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ মাধুরছড়ায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। রোহিঙ্গাশিবিরের পয়োবর্জ্য, পলিথিনসহ নানা বর্জ্য সেখানে পড়ছিল। এতে ছড়া শুকিয়ে যায়। এতে পাশের সংরক্ষিত বনের প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ইউএনএইচসিআরের আর্থিক সহায়তায় সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) ওই ছড়া আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ৪ লাখ ৪১ হাজার ডলার ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে। তারা ছড়ার শুকিয়ে যাওয়া অংশ খনন করে ও দুই পাড়ে গাছ লাগায়। রোহিঙ্গাশিবির থেকে আসা পয়োবর্জ্য পরিশোধনে একটি বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করে। এসব উদ্যোগে মাধুরছড়ায় পানি ফিরে আসে। সেখানে এখন মাছও মেলে।

সিএনআরএসের পরিচালক আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘মাধুরছড়াটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছি।’

হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খাল উন্নয়ন প্রকল্প

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে মোট ৬০টি খাল ছিল। গত ৫০ বছরে এ নগরের ৩৩ শতাংশ খাল, ৫৩ শতাংশ নিম্নাঞ্চল ও ৩০ শতাংশ জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিইডব্লিইউএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা শহর।

১৯৬০ সাল পর্যন্ত হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খাল ঢাকার নৌপথে চলাচলের অন্যতম জলাশয় ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে খালটি অন্যতম বর্জ্য ফেলার স্থানে পরিণত হয়। প্রায় দুই হাজার দখলদার ওই খালটিতে অবকাঠামো, বাড়িঘর ও বস্তি নির্মাণ করে। সরকার ওই খালকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে ৩০৩ একর জলাভূমি নিয়ে ২০০৭ সালে হাতিরঝিল প্রকল্প গ্রহণ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত ওই প্রকল্পের সুবিধা এখন ঢাকার মানুষ পাচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও দুই পাশের ফুটপাত নির্মাণ করা হয়। ৪০০ মিটার ওভারপাস, শিশুদের পার্ক, হাঁটার জায়গা, সবুজ এলাকাসহ আরও অনেক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।

রংপুরের কারুপণ্য শিল্পকারখানা

রংপুরে বেসরকারি সংস্থা কারুপণ্য লিমিটেড বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পণ্য শতরঞ্জি প্রস্তুতের একটি কারখানা নির্মাণ করে। প্রায় ২৭ হাজার ৮৭০ বর্গমিটার আয়তনের ওই কারখানাটি গাছে আচ্ছাদিত।

সেখানে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সেখানকার ৯০ শতাংশ শ্রমিক নারী। কারখানাটি পরিবেশবান্ধব হিসেবে নির্মাণ করায় বিদ্যুতের ব্যবহার ৯০ শতাংশ কম লাগে। ২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের বেশির ভাগ বড় ও মাঝারি প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব করে নির্মাণ করা সম্ভব। সেই সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি।’