ডলারে চুক্তি, খেসারত দিচ্ছে পিডিবি

সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ক্রয় চুক্তি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তিতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম হিসাব করা হয় মার্কিন ডলারে। গত এক বছরে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকা। এতে এক বছরে পিডিবির বাড়তি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। তারপরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি হচ্ছে ডলারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল টাকায় পরিশোধ করা হয়। কিন্তু চুক্তি ডলারে করায় বিল হিসাব করা হয় ডলারের চলতি বিনিময় হার ধরে। এক বছর আগে ১ ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বিল দিত পিডিবি। এখন সেই ডলার ১০৫ টাকা দরে বিল দিতে হচ্ছে।

আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
দেশে মার্কিন ডলারে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার বেশি দেখানোর জন্য ডলারের দাম ধরে রাখা হয়েছিল। এখন সেটার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

সরকার যদি চুক্তির সময় বিল টাকায় হিসাব করার শর্ত রাখত, তাহলে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো না। এই টাকা অবশ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই ওঠাচ্ছে সরকার। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে পিডিবির ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায়। গত জানুয়ারি মাসে দুই দফায় খুচরা বিদ্যুতের দাম ১০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১২ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঘাটতি সামলাতে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর চিন্তা আছে সরকারের।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও বিদ্যুৎ খাত বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ খাতে যা ইচ্ছা তা-ই করেছে। এখন ডলারের দাম বাড়ার পর তার চাপ ভোক্তার ওপর আসবে কেন? তিনি বলেন, শুধু লুণ্ঠন নয়, অদক্ষতা ও অযোগ্যতাও বিদ্যুৎ খাতের সর্বনাশ করেছে।

কেন্দ্রভাড়াও ডলারে

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ দেওয়া হয়। তখন থেকে এ খাতে দেশি বিনিয়োগ বাড়ে। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট, যদিও বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের নিচে। ফলে সব সময়ই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। বছরে এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এই ভাড়াও ডলারেই হিসাব হয়। ডলারের দাম বাড়লে খরচ বাড়ে।

পিডিবি ও বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্ট একটি অংশ বলছে, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই ডলারে বিদ্যুৎ বিলের চুক্তি করা হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক রীতি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ হয় আমদানিতে। কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদেশি ঋণ থাকে। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলের হিসাব ডলারে রাখা হয়। এটি না হলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না।

পিডিবির দুই কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলে দুটি অংশ থাকে। একটি স্থায়ী খরচ, যা কেন্দ্রভাড়া। আরেকটি অংশ জ্বালানি ও পরিচালন খরচ, যা জ্বালানি কেনার ওপর ভিত্তি করে বাড়ে বা কমে। কেন্দ্রভাড়ার অংশটি শুধু ডলারে না রেখে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বিদেশি ঋণ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে করা খরচ পরিশোধে বিল ডলারে ধরা যেতে পারে। আর জমি কেনাসহ স্থানীয় পর্যায়ে অন্যান্য খরচের অংশটুকু টাকায় বিল করা যায়। পিডিবির সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এভাবেই বিদ্যুৎ বিল হিসাব করা হয়। তবে বেসরকারি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পুরোটাই ডলারে হিসাব করা হচ্ছে। আর সৌরচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সবই ডলারে চুক্তি করা হচ্ছে।

নতুন মহাপরিকল্পনা অনুসারে সৌরচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে জমির খরচ অনেক, এটি কেনা হয় টাকায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জমির ব্যয় তো ডলারে পরিশোধের যুক্তি নেই।

পিডিবির তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে ১৫৪টি। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫৮টি। যৌথ উদ্যোগে চালু বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। আর বাকি ৯৪টি বেসরকারি খাতে নির্মিত। প্রতিবছর নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছে পিডিবি।

পিডিবি সূত্র বলছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পিডিবির এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১১ টাকা। এখন তারা এটি পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করছে ৬ টাকা ৭০ পয়সায়। এতে আয়-ব্যয়ে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে পিডিবির। সরকারের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরেও ভর্তুকি বরাদ্দ আছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে ঘাটতি ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া জমেছে চার মাসের। গ্যাস বিলও বকেয়া।

তবে পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও পিডিবির ঘাটতি দূর হচ্ছে না। একলাফে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৮১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গ্যাস বিলে পিডিবির বাড়তি খরচ হবে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আর দুই দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়েছে পিডিবি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার বাড়তি বোঝা। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ডলারের দাম বাড়ছে। তাই নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে ডলারের পরিবর্তে টাকায় চুক্তি করার কথা ভাবছে তারা। দুজন কর্মকর্তা বলেন, এটা নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে পারে সরকার।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিলে আমদানি ও দেশীয় খরচ হিসেবে দুটি অংশ থাকে। দেশীয় খরচের অংশটুকু টাকায় বিল করার কথা ভাবা হচ্ছে। সামনে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির সময় এটি করা হতে পারে।

‘এখন সেটার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে’

ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চাল, গম, তেল, চিনি, শিশুখাদ্য, শিল্পের কাঁচামাল—সবকিছুতেই ডলারের দামের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে সরাসরি যেমন মানুষের ব্যয় বেড়েছে, তেমনি পরোক্ষভাবে বিদ্যুতের দামের সঙ্গেও দিতে হচ্ছে মাশুল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাত-আট বছর ধরেই ডলারের দাম ধীরে ধীরে সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক দাম ধরে রাখে। যদিও চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ তাদের ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছিল। এতে আমদানি নিরুৎসাহিত হয়, রপ্তানি উৎসাহিত হয়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি মার্কিন ডলারেই হয়। কারণ হলো, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিময় হারের ওঠানামার ঝুঁকি নিতে চায় না। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রয় চুক্তি বাংলাদেশি মুদ্রায় হতে পারে।

ডলারের দাম এক বছরে প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কোনো নীতিব্যর্থতা ছিল কি না, জানতে চাইলে আহসান মনসুর বলেন, অবশ্যই। দেশে মার্কিন ডলারে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার বেশি দেখানোর জন্য ডলারের দাম ধরে রাখা হয়েছিল। এখন সেটার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে।