‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সোনার হরিণ হয়েই থাকে’

  • বিভিন্ন আদালতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি।

  • বিচারক–স্বল্পতাকে মামলাজট বা মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতীকী ছবি

দেশের সংবিধান বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে থাকবে—এমন ঘোষণা দিলেও কার্যক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সোনার হরিণ হয়েই থাকে। এমন অভিমত উঠে এসেছে আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দুঃখজনক হলেও বিচার বিভাগ কোনো সময়ই সরকারের কাছ থেকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।

আইন কমিশনের এই প্রতিবেদন গতকাল মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার জন্য বিচারক–সংকটসহ বেশ কিছু কারণও তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি মামলাজট নিরসনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

দেশে প্রচলিত আইন পুনর্নিরীক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ পেশ করার উদ্দেশ্যে আইন কমিশন গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে গঠিত এই কমিশনের প্রধান কাজ হচ্ছে, সব আইন সর্বদা বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা।

আইন কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ১৫ বছরে বিচারাধীন মামলা বেড়ে

দ্বিগুণ হয়েছে। বিভিন্ন আদালতে এখন ৪০ লাখের বেশি মামলা রয়েছে। এই হিসাব গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

আইন কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বছর ওয়ারি মামলা দায়ের, মামলা নিষ্পত্তি ও বিচারাধীন মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে আইন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই অস্বাভাবিক মামলাজট নিরসনের ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের শুধু আস্থাই হারিয়ে যাবে না; বরং বিচারব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৬ হাজার ৮৯২টি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯২৮টি। হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৮ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৪টি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে ২০০৮ সালে মামলা ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১২১টি। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলা বেড়ে হয়েছে ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ১টি।

বিচারক–স্বল্পতাকে মামলাজট বা মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইন কমিশন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আপিল বিভাগে বিচারকপ্রতি মামলা রয়েছে ২ হাজার ৪৯১টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকপ্রতি মামলা রয়েছে ৫ হাজার ৭৪১টি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বিচারকের সংখ্যা প্রায় ২০০০। এর মধ্যে ডেপুটেশনে রয়েছেন প্রায় ২০০ বিচারক। সেই হিসাবে জেলা পর্যায়ে বিচারকপ্রতি মামলা আছে ২ হাজার ৩৩টি।

আইন কমিশন বলছে, দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। সে হিসাবে দেশে ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা মাত্র একজন, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৮৬ জনের জন্য বিচারক রয়েছেন একজন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজারে একজন বিচারক। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে ৪৭ হাজার ৬১৯ জনের জন্য একজন বিচারক রয়েছেন। পাকিস্তানে ৫০ হাজার মানুষের জন্য বিচারক রয়েছেন একজন।

আইন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেট কম। অনেক আদালত ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে পরিচালিত হয়। ফলে একজন বিচারককে তার নিজস্ব আদালতের মামলার অতিরিক্ত মামলার বিচারের দায়িত্ব নিতে হয়। এতে বিচারকেরা অনেক সময় যথাযথ মনোসংযোগ দিতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয় এবং ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। তাছাড়া যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজেরা দেওয়ানি আপিল, রিভিশন, ফৌজদারি আপিলের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন বিচারককে একাধিক আদালতের মামলার বিচারকাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। অনেক আদালতের বিচারক এত বেশি মামলার ভারে ভারাক্রান্ত যে তিনি যদি শুধু স্বাক্ষরও করেন, তাতেও অনেক সময় ব্যয় হয়। ফলে প্রতিদিনের সব মামলা শুনানি করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। মামলার জট কমাতে অতি দ্রুত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেছে কমিশন।

আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন। আইন কমিশনের প্রতিবেদনে বেশ কিছু বাস্তবমুখী ও যৌক্তিক সুপারিশ আছে। প্রতিবেদনটি বেশ দীর্ঘ। সংসদীয় কমিটির আগামী কোনো বৈঠকে এই প্রতিবেদন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়কে মামলাজট নিরসনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হবে।