‘মাকে সারাক্ষণ মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে করে’
‘নূরজাহান, নূরজাহান!
সিন্ধু নদীতে ভেসে,
এলে মেঘলামতীর দেশে, ইরানি গুলিস্তান...’
এই নজরুলগীতির সঙ্গে নিজস্ব ভঙ্গিতে নাচছেন ৫১ বছর বয়সী তৌহিদুর রহমান খান। টি আর খান নামেই বেশি পরিচিত তিনি। সামনে ৭৩ বছর বয়সী মা নূরজাহান বেগম। ছেলের নাচ দেখে মা হেসে কুটিকুটি হচ্ছেন। আর ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন।
চিত্রটি একটি ভিডিওর। গত ৮ জুন সেটি ফেসবুকে পোস্ট করেন টি আর খান। ৮ অক্টোবর রাত আটটা পর্যন্ত ভিডিওটি দেখা হয়েছে ১৭ লাখের বেশি বার। ৩৯ হাজার মানুষ সেটিতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। মন্তব্য এসেছে দেড় হাজারের বেশি।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান খানের ডাকনাম তাহিম। ফেসবুকে তাঁর নাম টি আর খান তাহিম। তাঁর ফেসবুকে ঢুঁ দিলে দেখা যায়, ছেলে মাকে খাইয়ে দিচ্ছেন, মায়ের নখ কেটে দিচ্ছেন, মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে সাহায্য করছেন বা অফিস থেকে ফিরে মাকে চটানোর চেষ্টা করছেন—এমন অনেক ভিডিও। মায়ের সঙ্গে ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েও ভিডিও রয়েছে।
শনিবার বিকেলে মুঠোফোনে টি আর খানের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। মা নূরজাহান বেগম পাশেই বসে ছিলেন। মুঠোফোনের এ প্রান্ত থেকেও মা-ছেলের হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। টি আর খান জানালেন, আগে থেকেই তাঁর মা সামান্য কোনো বিষয়ে হেসে কুটিকুটি হতেন। তিনিও মায়ের এই গুণ পেয়েছেন। প্রাণ খুলে হাসতে পারেন।
ছয় থেকে সাত বছর ধরে মা নূরজাহান বেগম চট্টগ্রামের লালখান বাজারে টি আর খানের বাসায় আছেন। টি আর খানের স্ত্রী কানিজ তাসলিমা ও স্নাতকের শিক্ষার্থী দুই ছেলে-মেয়ে নূরজাহান বেগমের দেখাশোনা করছেন। টি আর খানের আরেক মেয়ের বয়স ছয় বছর।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান খানের ডাকনাম তাহিম। ফেসবুকে তাঁর নাম টি আর খান তাহিম। তাঁর ফেসবুকে ঢুঁ দিলে দেখা যায়, ছেলে মাকে খাইয়ে দিচ্ছেন, মায়ের নখ কেটে দিচ্ছেন, মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে সাহায্য করছেন বা অফিস থেকে ফিরে মাকে চটানোর চেষ্টা করছেন—এমন অনেক ভিডিও। মায়ের সঙ্গে ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েও ভিডিও রয়েছে।
নূরজাহান বেগম একা হাঁটতে পারেন না। একা গোসলও করতে পারেন না। তবে প্রতিদিন গোসল করতেই হবে তাঁকে। খাবার খেতে গেলে হাত কাঁপে, তাই বেশির ভাগ সময় ছেলেই মাকে খাইয়ে দেন। মায়ের হাতে-পায়ে ব্যথা হয়, তাই কাজ শেষে বাসায় ফিরে হাত-পা টিপে দেন তিনি। টি আর খানের ভাইবোনেরাও সময় পেলে মাকে সঙ্গ দিয়ে যান। অল্প সময়ের জন্য অন্য সন্তানদের বাসা থেকে ঘুরেও আসেন মা।
মাকে দেখভাল করতে তাঁর স্ত্রী বিরক্ত হচ্ছেন না বা সংসারে এ নিয়ে কোনো অশান্তি হচ্ছে না বলে জানালেন টি আর খান। স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বললেন, ‘ব্যস্ততায় অনেক সময় আমি মায়ের কোনো কাজের কথা ভুলে গেলে স্ত্রী মনে করিয়ে দেয়। আর বাসায় প্রায় সময় মায়ের সব কাজ তো আমার স্ত্রীই করছে।’
টি আর খান জানালেন, তাঁরা চার ভাই এক বোন ছিলেন। ১৯৯৮ সালে বড় ভাই নাসিম উদ্দিন খান সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনার পর মা অসুস্থ হতে থাকেন। ২০১৩ সালে বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিক মারা যান। তার পর থেকেই সারাক্ষণ সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকা মায়ের শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে।
টি আর খানের জন্ম ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর। মায়ের গল্প বলতে গিয়ে এই আইনজীবী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মা তাঁকে গর্ভে নিয়েই ১৩ মাইল হেঁটে নানার বাসায় যান। বললেন, ‘যেদিন আমার জন্ম হয়, সেদিন নানার বাসার কাছেই গোলাগুলি চলছিল। চিকিৎসক তো দূরের কথা, ধাত্রীও পাওয়া যায়নি। সবাই ভেবেই নিয়েছিলেন মাকে বাঁচানো যাবে না। নানি আনাড়ি হাতে মায়ের গর্ভ থেকে আমাকে বের করেন। তিনি ভয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন। নাড়ি কাটতে ভুলে গিয়েছিলেন। পরে মা মনে করিয়ে দেন।’
টি আর খান জানালেন, একবার তাঁর টাইফয়েড হয়েছিল। টানা দুই মাস হাসপাতাল ও বাসায় সেবাযত্ন করে তাঁকে সুস্থ করেছিলেন মা। এতে নূরজাহান বেগম নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বললেন, ‘আমার এই মাকে তো সারাক্ষণ মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে করে।’
টি আর খান ফেসবুকে মাকে নিয়ে ভিডিও দেন বলে অনেকে নেতিবাচক মন্তব্যও করেন। বলেন, লোকদেখানোর জন্য তিনি এসব করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অট্টহাসি দিয়ে টি আর খান প্রথম আলোকে বলেন, এ ভিডিও দেখে কেউ কেউ মানসিকভাবে ধাক্কা খেতে পারেন। সে কারণে হয়তো এমন মন্তব্য করেন।
তবে এমন মন্তব্যকারীর সংখ্যা খুবই কম বলে জানালেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, অনেকেই ফোন করে বলেন, ‘আপনার দেওয়া ভিডিও দেখে মায়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে।’ এটা অনেক বড় পাওয়া। এতে একজন মা-ও যদি সন্তানের কাছ থেকে একটু বাড়তি যত্ন-ভালোবাসা পান, তা-ও অনেক। বর্তমানে তো বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা বা যত্নে অনেক সন্তানই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না।
টি আর খান বললেন, ‘আমি আমার মাকে সম্মান করছি। আমার ছেলে-মেয়েরা তা দেখে শিখছে। এখন পর্যন্ত তারা তাদের বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করছে। ভবিষ্যতের কথা তো আর বলতে পারব না। এটিও কিন্তু জীবনে একটি বড় পাওয়া।’
জাগ্রত আইনজীবী পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন টি আর খান। আইনজীবীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন তিনি। তাঁর ফেসবুকে এ নিয়েও অনেক ছবি ও ভিডিও আছে।
টি আর খান বললেন, ‘আমি আমার মাকে সম্মান করছি। আমার ছেলে-মেয়েরা তা দেখে শিখছে। এখন পর্যন্ত তারা তাদের বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করছে। ভবিষ্যতের কথা তো আর বলতে পারব না। এটিও কিন্তু জীবনে একটি বড় পাওয়া।’
টি আর খান শুধু মা বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মজা করেন, তেমনটা নয়। তিনি সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও সারাক্ষণ আনন্দে মেতে থাকেন। আদালতে কাজ শেষ করে চেম্বারে গিয়ে দেখেন, মক্কেল বসে আছেন। তাই ক্লান্তি দূর করতে চেম্বারের সহকর্মী এবং আগত মক্কেলকে নিয়েই কিছুক্ষণ নেচে নেন।
টি আর খানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় নাচে অংশ নেওয়া আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। তাঁরা একসঙ্গে ঘুরতে যান। ফুটবল-ক্রিকেট খেলায় অংশ নেন। তাঁদের নিয়ে টিম হট হর্সেস অ্যান্ড ট্যুর গ্রুপ ও হট হর্সেস স্পোর্টস টিম অ্যান্ড ট্যুর গ্রুপ নামের দুটি দল গঠন করেছেন। তাঁরা মন চাইলে গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকেন, নাচ তো আছেই। মাঝেমধ্যে ব্যান্ড পার্টি এনেও আনন্দ করেন।
সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে গানের তালে তালে নেচেছিলেন টি আর খান। এ নিয়ে হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে নাচ বা গানের প্রস্তুতি থাকে না। একটি গান নির্বাচন করে নাচটা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করি। এরপর মাঠে নেমে যাই। আমি সামনে থাকি। আমি হাত-পা যেভাবে নাড়াই, অন্যরাও তা করার চেষ্টা করেন। সবার পোশাক এক রকম থাকে বলে মনে হয়, সবাই একই তালে নাচছেন। আসলে কিন্তু তা নয়।’
একজন আইনজীবী হয়ে এভাবে নেচে-গেয়ে জীবন উপভোগ করার বিষয়টিকে অনেক আইনজীবীই ভালো চোখে দেখেন না। তাঁদের মতে, আইনজীবীদের মধ্যে একটু গম্ভীর ভাব থাকবে। জ্ঞানীগুণী ভাব থাকবে। তা না করে সারাক্ষণ কেন আনন্দে মেতে থাকতে হবে?
এ প্রশ্নের জবাবও নিজেই দিলেন টি আর খান। বললেন, ‘জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। চোখের সামনে নিজের ভাইয়ের লাশ দেখেছি। তবে এসব নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে তো কোনো ফায়দা নেই। আমি আমার পেশার প্রতি কতটা দায়িত্বশীল, সেটাই বড় কথা। এরপর ব্যক্তিজীবনটা একান্তই আমার। জন্ম যখন হয়েছে, তখন একদিন না একদিন মরতে হবেই। মাঝখানে যেটুকু সময় পাওয়া যায়, তা আনন্দ আর হাসিতে কাটিয়ে দিতে চাই। এতে তো কারও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।’
টি আর খান সচেতনভাবেই ইয়াবা, ধর্ষণ—বিশেষ করে শিশু ধর্ষকের পক্ষে কখনোই মামলা লড়েন না বলে জানালেন। কেননা, হাসি-আনন্দে কাটানো একজন মানুষকে এ বিষয়গুলো মানসিকভাবে ভীষণ পীড়া দেয়।
চট্টগ্রামের জজ কোর্টের আইনজীবী জাফর ইকবাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টি আর খান আমাদের সিনিয়র। তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। আমরা জীবনকে উপভোগ করতে পারি না, কিন্তু টি আর খান জীবনকে তাঁর মতো করে উপভোগ করছেন। তাঁকে দেখে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে। আর আইনজীবী বলে এভাবে জীবনকে উপভোগ করতে পারবেন না, তা তো কোথাও লেখা নেই। তিনি বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গেও যুক্ত।’
টি আর খান জানালেন, তাঁর বাবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। খানিকটা মেজাজি ছিলেন। তবে মায়ের সঙ্গে বোঝাপড়াটা বেশ ভালো ছিল। বললেন, ‘বাবা সৎ মানুষ ছিলেন। কখনো কোনো বাজে কাজ করেছেন বলে শুনিনি। সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে সরকারি চাকরি নিয়ে ইরাকে চলে গিয়েছিলেন। আমরা ভাইবোনেরা বাবার আদর্শ মেনে চলার চেষ্টা করি।’
টি আর খান বললেন, ‘আমার অনেক সম্পত্তি নেই। তা নিয়ে আফসোসও নেই। বুক উঁচিয়ে বলতে পারি, আমি কারোরটা মেরে খাইনি। এই যে ছুটির দিনে মায়ের পাশে পা ছড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসে হাসতে পারছি, এটাই আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া।’