শহরের চেয়ে গ্রামে তালাক বেশি 

প্রতি ১০ হাজারে গ্রামে ১১টি এবং শহরে ৯টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার অনেকটা বেড়েছে।

প্রতীকী ছবি

দেশে শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় বিয়ে বেশি হচ্ছে। তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদও গ্রাম এলাকায় বেশি। প্রতি ১০ হাজারে গ্রামে ১১টি এবং শহরে ৯টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে গ্রামে বিয়ের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৬৮টি আর শহরে ১২০টি। তবে সার্বিকভাবে দেশে বিয়ের হার অনেকটা কমেছে। আর বিয়ের গড় বয়স কিছুটা বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত রোববার বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে বৈবাহিক অবস্থা, বিয়ের বয়স, তালাক ও বিচ্ছেদের বিষয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিবিএস ৩ লাখ ৮ হাজার ৩২টি পরিবারের ওপরে জরিপ পরিচালনা করে।

আরও পড়ুন

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ ও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দেশে তালাকের হার অনেক বেড়েছিল। ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে তালাকের হার ছিল প্রতি ১০ হাজারে যথাক্রমে ৭ ও ৮টি। এই হার ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫টিতে। বিবিএসের তথ্য বলছে, গত বছর দেশে সার্বিকভাবে তালাকের হার কমেছে। ২০২৩ সালে তালাকের হার ছিল প্রতি ১০ হাজারে ১১টি।

২০২০ ও ২০২১ সালে গ্রাম এলাকায় তালাকের সংখ্যা ছিল প্রতি ১০ হাজারে যথাক্রমে ৯টি ও ৮টি। একই সময়ে শহরে ছিল ৭টি ও ৮টি। ২০২২ সালে অবশ্য গ্রাম এলাকায় তালাকের হার আরও বেশি—প্রতি ১০ হাজারে ১৫টি। এ সময়ে শহরে যা ছিল ১০টি।

বাবা-মায়েরা পূর্বাপর চিন্তা না করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য, যৌতুকসহ নানা কারণে তারা সংসার করতে পারেনি।
মাহবুবা নাসরীন, সমাজবিজ্ঞানী

জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশকারী বিবিএসের এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তালাকের কারণ কী, সেটাও এই জরিপে জানার চেষ্টা হয়। তবে সেই চিত্রটি থাকবে মূল প্রতিবেদনে। মূল প্রতিবেদন আগামী জুনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। 

২০২২ সালের প্রতিবেদনে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা, ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদি উঠে এসেছিল।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহে খোঁজ নিয়ে তালাকের ঘটনা বাড়ছে বলে জানা যায়। কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামে তালাকের ঘটনা বেড়েছে। চট্টগ্রামে ২০২২ সালে বিচ্ছেদ ঘটে ৫ হাজার ৯৭৬টি, যা এর আগের ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রংপুর সিটি করপোরেশনসহ পুরো জেলায় ২০১৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল ৬ হাজার ৯৬৭টি। ২০২২ সালে এসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়ে ৭ হাজার ২১৫-তে। ময়মনসিংহ জেলায় তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তালাকের ঘটনা বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্রাম এলাকায় তালাক বেড়ে যাওয়ার পেছনে করোনা, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্যের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মাহবুবা নাসরীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরে বাল্যবিবাহ ও মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া অনেক বেড়েছে। বাবা-মায়েরা পূর্বাপর চিন্তা না করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য, যৌতুকসহ নানা কারণে তারা সংসার করতে পারেনি।

আগের পরিসংখ্যানের তুলনায় গ্রাম এলাকায় তালাক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নতুন জানিয়ে মাহবুবা নাসরীন বলেন, এই বিষয়ে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ বন্ধে পারিবারিক সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের প্রচার বাড়ানো জরুরি।

আরও পড়ুন

মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে বেড়েছে

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। এ বয়সের আগে বিয়ের কারণে অপরিণত বয়সে অনেক মেয়ে মা হন। এতে তাঁর যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, তেমনি শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার সুযোগও কমে যায়। সরকার দেশে বাল্যবিবাহ রোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ কমছে না; বরং বেড়েই চলেছে।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার অনেকটা বেড়েছে। ২০২৩ সালে দেশে ১৫ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ের সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের ঘটনা বেশি।

বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ খুঁজে বের করতে গত বছর দেশের ৫০ হাজার পরিবারের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রটেকশন (সেলপ) কর্মসূচি। ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ (কনে হওয়ার জন্যই যেন জন্ম) শিরোনামে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র ও ধনী—দুই ধরনের পরিবারেই ঘটছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের পেছনে দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাবের পাশাপাশি অভিভাবকেরা ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ার কথা বেশি বলছেন।

আরও পড়ুন

বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত বছর ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার ছিল ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৪৪ দশমিক ৪ আর শহর এলাকায় ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালের তুলনায় দেশে মেয়েদের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে বেড়েছে।

বিবিএসের জরিপের এই তথ্য বলছে, বাল্যবিবাহ বন্ধের পরিকল্পনা থেকে সরকার অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশ কমানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার লক্ষ্য রয়েছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭-এর ১৯ ধারায় বিশেষ বিধান অনুসারে, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের সম্মতিতে বিধি অনুসরণ করলে সেই বিয়ে বাল্যবিবাহের অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, আগেও বয়স চুরি করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো। সরকার কম বয়সে বিয়ের সুযোগ রাখায় সেটার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। করোনা ও পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটেও মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে বেড়েছে। তিনি বলেন, গ্রামীণ এলাকায় তালাক কেন বেড়েছে, সেটার বিশদ অনুসন্ধান প্রয়োজন। তবে তালাকের ক্ষেত্রেও অল্প বয়সে বিয়ের প্রভাব থাকে।