'কোনো দিন ভাববার পাই নাই ভোট দিবার পাম'

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী শতবর্ষী সুখ বেওয়া ছেলের সঙ্গে নাগদহ কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছেন। ছবিটি আজ সোমবার সকাল ১০টায় নাগদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: সফি খান।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী শতবর্ষী সুখ বেওয়া ছেলের সঙ্গে নাগদহ কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছেন। ছবিটি আজ সোমবার সকাল ১০টায় নাগদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: সফি খান।

‘জীবনের প্রথম ভোট দিলাম। প্রথম প্রথম ভয় নাগছিল। এ্যালা খুব ভালো নাগবার নাগছে। কোনো দিন ভাববার পাই নাই ভোট দিবার পাম।’ বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ৮৩ বছর বয়সী সহিজন বেগম জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে এ কথা বলেন। ওই কেন্দ্রের প্রথম ভোটটি দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী ৬৯ বছর পর এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছেন।
কুড়িগ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশে ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত বিলুপ্ত ছিটমহলভুক্ত ছয়টি ইউনিয়নে আজ সকাল আটটা থেকে ভোট নেওয়া শুরু হয়। দাশিয়ার ছড়া শেখ ফজিলাতুন্নেছা দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের প্রথম ভোটটি দেন সহিজন বেগম (৮৩)। তাঁর বাড়ি ফুলবাড়ী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত সদ্য বিলুপ্ত দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলে। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে ৬৯ বছর পর ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।

জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) পাথরডুবি, শিলখুড়ি ও ভূরুঙ্গামারী সদর এবং ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর, ভাঙামোড় ও ফুলবাড়ী সদর মোট ছয়টি ইউপিতে ১০টি বিলুপ্ত ছিটমহল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯। এর মধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহলের ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৭৮০। ৩১ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৩৪৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ছয়টি ইউনিয়নের ৮৪টি কেন্দ্রের ৪৩১টি বুথে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আনসার, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) মোতায়েন করা হয়েছে।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি ছাড়াও ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের দুজনসহ ১৫ প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর ফুলবাড়ী উপজেলায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, ইসলামী শাসনতন্ত্র, জাসদের একজনসহ ১৬ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন।

সকালে ভোটকেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ ভোটাররা দলে দলে ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছেন। এলাকাজুড়ে সাজ সাজ রব। অনেক ভোটারকে নতুন পোশাক পরে ভোট দিতে দেখা যায়।

দাশিয়ার ছড়া শেখ ফজিলাতুন্নেছা দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রায়হান উদ্দিন সরদার জানান, এখানে মোট ভোটার ৭৮৬ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ৪০৪ জন ও পুরুষ ভোটার ৩৮২ জন। এই কেন্দ্রে বেলা ১১টা পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ ভোট পড়েছে।

ফুলবাড়ী নাগদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটাররা রোদের মধ্যে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে।
এ কেন্দ্রে সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ার ছড়ার শত বছর বয়সী সুখ বেওয়া ছেলের সঙ্গে ভোট দিতে এসেছেন। জীবনের প্রথম ভোট দিয়ে বাইরে এসে তিনি বলেন, ‘কাল থাকি ঘুম আইসে না। কী আর কম, বাবা, কেমন করি ভোট দেয় জানি না। আজ শিখলোং। আগত বাংলার মানুষ ভোট দিছে। আমরা দেখছি। দিবার পাই নাই। এবার দিয়া খুব ভালো নাগবার নাগছে।’

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাগদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন বৃদ্ধ রাহেলা বেওয়া। ছবি: সফি খান।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাগদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন বৃদ্ধ রাহেলা বেওয়া। ছবি: সফি খান।

এ কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন রাশমেলা এলাকার ঝরনা রানী। একই রকম আনন্দ প্রকাশ করলেন তিনি।

কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রাশেদুল হক জানান, এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ হাজার ৭৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩২৩ জন, নারী ভোটার ৩২৬ জন। সকাল ১০টা পর্যন্ত ৪০০টি ভোট পড়েছে। তিনি জানান, বিলুপ্ত ছিটমহল রাশমেলা, খুনিয়াটারী ও বানিয়াটারীর বাসিন্দারা ভোট দিচ্ছেন। এই তিন ছিটমহলে ভোটার ৬৪৯ জন।
দাশিয়ার ছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ নতুন পোশাক পরে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন। উৎসবের আমেজ। ছিটমহলের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান ও নূর ইসলাম জানান, ৬৯ বছর পর প্রথমবার এ এলাকার লোকজন ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এত দীর্ঘ সময় তাঁরা নাগরিকত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। প্রথমবার ভোট দিতে পেরে তাই সবাই আনন্দে ভাসছেন।

চরাদ্রখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ওবায়দুল হক জানান, এখানে আজ সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৩০ শতাংশ ভোট পড়েছে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা।