জিঞ্জিরা প্রাসাদ: হারানো দিনের গল্প

কেরানীগঞ্জের ঐতিহাসিক জিঞ্জিরা প্রাসাদের ভগ্নপ্রায় একাংশ। ৩০ অক্টোবর ছবিটি তুলেছেন জাহিদুল করিম
কেরানীগঞ্জের ঐতিহাসিক জিঞ্জিরা প্রাসাদের ভগ্নপ্রায় একাংশ। ৩০ অক্টোবর ছবিটি তুলেছেন জাহিদুল করিম

চোখের সামনে একটি প্রাচীন ভবনের খণ্ডাংশ দাঁড়িয়ে। আস্তর খসে বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো দিনের ইট। অন্ধকার তিনটি প্রকোষ্ঠ। তিনটি পরিবারের বসতবাড়ি। বাইরে থেকে বানানো সরু সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার ব্যবস্থা। সেখানে নারকেল, নিম ও শজনেগাছের বাড়বাড়ন্ত। চারদিক দিয়ে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়েছে পাঁচতলা-ছয়তলা অসংখ্য ভবন। তাই কাছে না গেলে প্রাচীন ভবনটির অস্তিত্ব বোঝা যায় না।
এই ভবনের প্রতিটি ইটের গায়ে লেখা রয়েছে টুকরো টুকরো ইতিহাস। সে খবর কজনই বা রাখেন!
এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। অথচ ভবনটির গায়ে কোথাও তার চিহ্ন নেই।
ভবনটি আসলে চার শ বছর আগে নির্মিত জিঞ্জিরা প্রাসাদের একটি ভঙ্গুর অংশ। বাংলার মোগল সুবাদার দ্বিতীয় ইবরাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) প্রাসাদটি বানিয়েছিলেন তাঁর প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে।
গত ২৫ অক্টোবর সকালবেলা কেরানীগঞ্জের কদমতলী চৌরাস্তা থেকে সহজেই পৌঁছে যাই জিঞ্জিরা। একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি ফটক পেরিয়ে, গলিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় প্রাসাদের টিকে থাকা টুকরো ভবনটির কাছে। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় এলাকাটি ‘হাউলি’ নামে পরিচিত।
হাউলি শব্দটি ফারসি হাভেলি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ আবাসিক এলাকা। আর জিঞ্জিরা শব্দটি আরবি জাজিরা (উপদ্বীপ) শব্দের বিকৃত রূপ। স্থানটি নদী ও পরিখা দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ায় এ রকম নামকরণ বলে মত ঐতিহাসিকদের।
এখন যেখানে বড় বড় ভবন উঠেছে, সেসব এলাকাসহ পুরো এলাকাটি ছিল জিঞ্জিরা প্রাসাদের আওতাভুক্ত। এখন মাত্র প্রাসাদ ভবনের দুটি খণ্ডাংশ টিকে রয়েছে। সেখানেও মানুষের বসতি। তবে এলাকাটিতে পর্যটকদের সাদরে বরণ করা হয় না, বরং স্থানীয়রা নতুন মানুষদের দেখেন বেশ সন্দেহের চোখে।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ বইয়ের তথ্যানুসারে, সুবাদার ইবরাহিম খান ঢাকার বাইরে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরে হাউলি গ্রামে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাগান, হাম্মামখানা (স্নানঘর) সংবলিত প্রাসাদ তৈরি করেন। এখানে আসার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করেন। এই বইয়ের তথ্য অনুসারে, ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খান বাংলার দেওয়ানি মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নিলে জিঞ্জিরা প্রাসাদের অবনতি শুরু হয়।
বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, জিঞ্জিরা প্রাসাদে ছিল মূল প্রাসাদ ভবন, আয়তাকার সুবিস্তৃত দ্বিতল হাম্মাম, দক্ষিণের সদরে প্রহরীকক্ষসহ দ্বিতল প্রবেশ ফটক এবং দুটি অষ্টকোণী পার্শ্ব বুরুজ। পলেস্তারা দেয়ালঘেরা কক্ষগুলো ছিল আয়তাকার এবং ওপরে কুঁড়েঘর আকৃতির চৌচালা খিলানাকার ছাদ।
অনেক বেদনাবিধুর ঘটনার নীরব সাক্ষী এই জিঞ্জিরা প্রাসাদ। ইতিহাসের বইপত্রে পাওয়া যায়, নবাব সরফরাজ খানের (১৭৩৯-১৭৪০) পতনের পর তাঁর মাতা, স্ত্রী, বোন, পুত্র, কন্যাসহ হারেমের কিছু নারীকে এখানে বন্দী করা হয়। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস যে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর আলীবর্দী খানের প্রধান রানি শরীফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা বেগম, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অন্যতম নেপথ্য কারিগর খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ও কন্যা কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরাকে জিঞ্জিরা প্রাসাদে এনে কড়া পাহারায় রাখা হয়। জনশ্রুতি আছে, নবাব মীর জাফর আলী খানের পুত্র মীর সাদেক আলী খান ওরফে মীরনের নির্দেশে জমাদার বকর খান মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে প্রাসাদ থেকে নৌকায় তুলে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে।
বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এ প্রাসাদের যতটুকু এখনো অবশিষ্ট আছে, সেটুকুই রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের হিসাবমতে, জিনজিরা প্রাসাদের জমি অধিগ্রহণসহ সংস্কারের জন্য ২০ কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে। এসব জানিয়ে জেলা প্রশাসক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে তিনি চিঠিও দিয়েছেন।
জিঞ্জিরা প্রাসাদকে রক্ষা তো দূরের কথা, এটি যে একটি ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’, সেই সাইনবোর্ডটিও ভবনের পাশে লাগাতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বললেন, তাঁরা ভবনটি রক্ষায় আন্তরিক। বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও তাঁরা অবগত। আর ভবনটির গায়ে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ সাইনবোর্ড অচিরেই লাগানো সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে কেরানীগঞ্জের ইউএনওকে তাঁরা এ নির্দেশ দিয়েছেন। কাজটির অগ্রগতিও তিনি তদারক করবেন বলে জানালেন।