নতুন কৌশলে ভারতীয় চ্যানেলে চলে যাচ্ছে দেশি বিজ্ঞাপন

.
.

বিদেশি চ্যানেল কেবল বাংলাদেশের জন্য আলাদাভাবে ডাউনলিংক এবং সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলো। এতে একদিকে এ দেশের টেলিভিশন দর্শক হারাচ্ছে, অন্যদিকে বিজ্ঞাপন চলে যাওয়ার কারণে দেশীয় চ্যানেলগুলোর আয় কমছে।
বাংলাদেশের দর্শক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের চাহিদার কারণে ভারতের দুটি টেলিভিশন চ্যানেল এ দেশের দর্শকদের জন্য স্যাটেলাইটে আলাদা ‘বিম’ তৈরি করেছে। ফলে এই চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠান বাংলাদেশে দেখা গেলেও ভারতে দেখা যায় না। এই চ্যানেলে প্রচারিত বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ভারতে দেখা যাচ্ছে না। আলাদা ‘বিম’ হওয়ায় ওই সব চ্যানেলে দেশের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য অর্থও কম লাগছে। ফলে দেশি বিজ্ঞাপনদাতারাও সেখানে বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী হচ্ছেন।
ভারতের জি ও স্টার গ্রুপের দুটি চ্যানেল ‘জি বাংলা’ ও ‘স্টার জলসা’ আলাদা বিমে বাংলাদেশে মাত্র ৩ লাখ টাকায় ডাউনলিংক করে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন নিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের হিসাবে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পেয়েছে এ দুটি চ্যানেল। অন্যদিকে সরকারি হিসাবে এটা প্রায় ১৪ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশ কেব্‌ল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬-এর ১৯ (১৩) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে। এ কারণে দুটি অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে ২২ নভেম্বর নোটিশ দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। নোটিশে এটিকে ওই আইনের ২৮ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে দুটি অপারেটরকে সতর্ক করা হয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানই মূলত বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেল ডাউনলিংক করে থাকে।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ নেই। এ কারণে দুটি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ করা হয়েছে।

টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর মালিকদের মতে, বাংলাদেশে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন বাজার বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে। দেশে এখন টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ২৭টি। আরও ১৭টি চ্যানেল অনুমতি পেয়েছে। তাঁদের মতে, বিজ্ঞাপনের অভাবে দুই-তৃতীয়াংশ চ্যানেল ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। এগুলোর অর্ধেকই চলছে লোকসানে।

এর মধ্যে গত বছর বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার অর্থ বৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করার পর সংকটে পড়ে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো। এই প্রজ্ঞাপনের কারণে ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া আগের তুলনায় বহু গুণ বেড়ে যায়।

একটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, আগে ভারতের বাজারে পণ্য বিক্রি করে এ রকম তিনটি প্রতিষ্ঠান ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দিত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপনের পর এখন ১২ থেকে ১৪টি বাংলাদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় দুটি বাংলা চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছে। এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবিতে সোচ্চার বেশির ভাগ বেসরকারি টেলিভিশনের মালিকদের গড়া সংগঠন মিডিয়া ইউনিটির সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। টেলিভিশন মালিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

অসম প্রতিযোগিতা

বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখানো নিষিদ্ধ না হলেও এর ওপর মাত্রাতিরিক্ত মাশুল আরোপ করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় রুপি মাশুল দিতে হবে। এখন পর্যন্ত কলকাতায় প্রচারের জন্য ভারতে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল নিবন্ধিত হয়নি।

অথচ বাংলাদেশে মাত্র ৩ লাখ টাকা মাশুল দিয়ে ভারতের চ্যানেল ডাউনলিংক করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের টেলিভিশনের মালিকেরা বলছেন, এটি একটি অসম প্রতিযোগিতা। তা ছাড়া চ্যানেলের আলাদা আলাদা ‘বিমের’ জন্য ভারতে কর্তৃপক্ষের আলাদা অনুমতিপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ‘বিম’ করে প্রচারিত চ্যানেলের জন্য ওই দেশের মূল চ্যানেলের খরচ খুব একটা বাড়ছে না।

বাংলাদেশের জন্য তৈরি বিমে প্রচারিত বিজ্ঞাপন কেবল বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। এতে ভারতে চ্যানেলটির প্রচার সময়ের কোনো ‘মিনিট বিজ্ঞাপন’ নষ্ট হচ্ছে না। অর্থাৎ, একই অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিরতিতে দুই দেশের লোক দুই রকম বিজ্ঞাপন দেখছে। এতে একটি চ্যানেল একই বিজ্ঞাপন বিরতিতে দুই দেশ থেকেই আয় করছে।

বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের গড়া সংগঠন মিডিয়া ইউনিটির সদস্যসচিব আরিফ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দাবি প্রতিযোগিতা যেন সমান হয়। এ দেশে বিদেশি চ্যানেলগুলো, বিশেষ করে ভারতের চ্যানেলগুলো সুযোগ বেশি পাচ্ছে। এটা তো দেশীয় চ্যানেলের সঙ্গে অন্যায় আচরণ। তিনি বলেন, দেশীয় চ্যানেলগুলোকে রক্ষার জন্য তারা আন্দোলন করছেন। এ কারণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে মিডিয়া ইউনিিট গঠন করা হয়েছে। তাঁরা দাবি আদায়ে সোচ্চার। আগামীকাল ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করবেন তাঁরা।

২০১৪ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশে ভারতের টিভি চ্যানেল সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করে তথ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) চিঠি পাঠান। যদিও সেই সুপারিশের কোনোটিই এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

 চিঠিতে ভারতের চ্যানেল বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থমন্ত্রী দুটি প্রস্তাব করেন। একটি হচ্ছে, ভারতের চ্যানেল বাংলাদেশে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ কোটি টাকা ফি আদায়। অন্যটি হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রচারিত ৪০টি চ্যানেলের পর ভারতের টিভি চ্যানেল রাখার ব্যবস্থা নেওয়া।