তথ্যচিত্র 'খালেদস ওয়ার' সাহসী প্রতিরোধের দলিল

মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় মানুষের সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়েও। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—
খালেদ মোশাররফ
খালেদ মোশাররফ

বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে কেঁপে ওঠে মন। অদ্ভুত এক আবেশে মুহ্যমান হয়ে তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন হাহাকার। পাকিস্তানি বাহিনী এসে লুট করেছে তাঁর বাড়ি। চোখের সামনে হত্যা করেছে দুই ছেলেকে, যে ছেলেদের একটু একটু করে বড় করেছিলেন তিনি। নিরাপত্তাহীন এই বৃদ্ধকে, এই বৃদ্ধের মতো অগণিত মানুষকে নিজের আবাস ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই ছিল খালেদের যুদ্ধ।
হ্যাঁ, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের কথাই বলছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, যিনি পরবর্তীকালে কে ফোর্সেরও অধিনায়ক ছিলেন। ভানিয়া কেউলির পরিচালনায় মেজর খালেদস ওয়ার তথ্যচিত্রে যে খালেদ অমর হয়ে আছেন।
দুঃসাহসিক ব্রিটিশ টিভি সাংবাদিক ভানিয়া কেউলি বিশ্বের নানান ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ঢুকে পড়ে তথ্যচিত্র বানানোয় ওস্তাদ। ফলে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে কেউলির অনুসন্ধানী ক্যামেরা ছুটে আসবে এটাই যেন স্বাভাবিক।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় এক নৃশংস সময় পার করেছে দেশ। দলে দলে মানুষ শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। যাঁরা দেশে আছেন, তাঁরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচার হত্যার সুখ ভোগ করছে। এরই সমান্তরালে চলছে প্রতিরোধ আন্দোলন। ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করার কথা ভাবছে বাংলার মানুষ। মেজর খালেদ তাদেরই একজন। পাকিস্তানি বাহিনীর পোড়ামাটি নীতির বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিবাদ যেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খালেদ মোশাররফকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হন এবং ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে সেনা বিদ্রোহের সময় খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর উত্তম এবং এ টি এম হায়দারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তথ্যচিত্রের ছবিতে এক কোমল কিশোরকে দেখি। মাইক ওয়াইট্যাকারের ক্যামেরা তার দিকে তাক করা। কিন্তু ক্যামেরার সামনে এসে কেমন যেন হয়ে যায় সে। নির্বাক, নিস্তব্ধ। জানা যায়, কিশোরের মা-বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। বিবাহিত বোনটিকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা। ছেলেটি খালেদের কাছে এসেছে হত্যা ও ধর্ষণের বদলা নিতে। যুদ্ধে যোগ দিতে তার বুকে যে ধিকিধিকি আগুন, তা নেভে না।

বিজয়ের মাস
বিজয়ের মাস

খালেদ মোশাররফ এখানে আশার প্রতীক। আত্মবিশ্বাসী। সাদা হাওয়াই শার্টটি ট্রাউজারে গোঁজা নয়। সুগঠিত শরীরের এই মানুষটি যখন কথা বলছেন, তখন তাঁর কণ্ঠস্বরে নেই বিন্দুমাত্র সংশয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতেই অবিচলিত খালেদ বলছেন, ‘তাদের আসতে দাও, হেরে যাবে।’
সামরিক বাহিনী থেকে পাওয়া শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে একমনে মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন তিনি, কথা বলছেন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে, নৌকায় করে যাচ্ছেন নতুন ঠিকানায়।
আমরা এই ছবিতে খালেদের কে ফোর্স কীভাবে গেরিলাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তা দেখি। গোলার প্রচণ্ড শব্দ আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দেয়। আবার যুদ্ধে দামামার মধ্যেও বাংলার চিরায়ত স্নিগ্ধ রূপটিও ফুটে ওঠে তথ্যচিত্রে: হালচাষরত কৃষক, ডোবার পানিতে অসহায় নারীর স্নান, কলসি কাঁখে গাঁয়ের বধূ। কিন্তু কলসিটা দাওয়ায় রাখার পর হৃদয়ছেঁড়া কান্নায় যখন ওই বধূর নাকের নোলক ভিজে যায় চোখের জলে, তখন নিজেকে আর ধরে রাখা যায় না।
খালেদ মোশাররফ পরিষ্কার দৃঢ়তায় ভর করে বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসী নই। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবই সন্ত্রাসের বিপক্ষে। কিন্তু নিরস্ত্র মানুষকে কসাইরা যখন হত্যা করতে থাকে, তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার। তারা তো প্রতিশোধ নেবেই।’

মেজর খালেদস ওয়ার তথ্যচিত্রের একটি দৃশ্য: রণাঙ্গণে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সশস্ত্র খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম
মেজর খালেদস ওয়ার তথ্যচিত্রের একটি দৃশ্য: রণাঙ্গণে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সশস্ত্র খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম

ছবির আরেকটি বিষয়েও মন আটকে যায়। পাকিস্তানি ঘাতকদের অগ্রযাত্রা রোধ করতে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে বিদ্যুৎব্যবস্থা, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে রেলপথ, সড়কপথ। কিন্তু সেটাও করা হচ্ছে খুব ভেবেচিন্তে। যুদ্ধ তো শেষ হবে কোনো এক বর্ণিল ভোরে। ‘এটা তো আমাদেরই দেশ, আমাদেরই সম্পদ’, দেশ স্বাধীন হলে যেন দ্রুত মেরামত করা যায়, তারও একটা সুযোগ রাখতে হবে তো!
পাকিস্তানিরা বলছিল, এটা কোনো যুদ্ধ নয়, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে মাত্র! খালেদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘এটা কোনো সীমান্ত সংঘর্ষ নয়। এটা নিয়মিত যুদ্ধ।’
এই ছবিতে আমরা দেখতে পাই নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি পরা তরুণদের। যারা জীবন বাজি রেখে এসেছে দেশকে রক্ষা করতে। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের এই অংশগ্রহণ যুদ্ধকে পরিণত করেছে জনযুদ্ধে।
গ্রানাডা টেলিভিশন নির্মাণ করেছিল খালেদকে নিয়ে এই তথ্যচিত্র। যুদ্ধের সময় জুন মাসে খালেদের বাহিনীর সঙ্গে আটটি দিন কাটিয়েছিলেন ভানিয়া কেউলি তাঁর দল নিয়ে। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন ভারতীয় লেখক ও টিভি সাংবাদিক ওগীতা মেহতা, সম্পাদনা করেছেন কেলভিন হেনড্রি। যুক্তরাজ্যে ১৯৭১ সালের ১২ জুলাই তথ্যচিত্রটি মুক্তি পায়।